নিজস্ব প্রতিবেদন: ৩৬ নং গিরিশ মুখার্জি রোড। তখনও সেই পাড়টার এত জাঁকজমক গড়ে ওঠেনি। হাতেগোনা কয়েকটা বাড়ি নিয়ে একটা অভিজাত পাড়া। একদিকে মুখোপাধ্যায়, অন্যদিকে ঘোষ বাড়ি, আর তার মাঝখানেই 'চাটুজ্যে বাড়ি'। সেই বাড়ির ডানদিকে ঘুরেই লেডিস পার্ক। পরিত্যাক্ত জলাভুমি, ঘন ঝোপঝাড় পরিপূর্ণ একটি পাড়া। লেডিস পার্ক তখন একটা ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠে একসময় নাটক হত। কথাতেই আছে বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। ফলে একাধিক অনুষ্ঠানে ওই মাঠে মূল আকর্ষণ ছিল 'নাটক'। বাঙালির 'আইকন' উত্তম কুমার। 'মহানায়ক' হিসাবে উত্থানের আগে কেমন ছিল তাঁর ছেলেবেলা? তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন সেকথা।
মহানায়কের আজ, ৩ সেপ্টেম্বর ৯৪ তম জন্মদিবস। উত্তম কুমার সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। সমালোচকেরাও তাঁর অভিনয় দক্ষতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই উত্তমের অভিনয়ের দিকে ঝোঁক ছিল চূড়ান্ত। সত্যজিত রায়ের 'নায়ক' ছবিতে যেন আমরা বাস্তবের উত্তমকেই দেখতে পাই। উত্তম বাবু নিজেও সে কথা স্বীকার করে বলেছিলেন, ওই চরিত্রের সঙ্গে তিনি নিজের অনেক মিল পেয়েছিলেন। তাই ওই ছবির একটি দৃশ্যের কথা স্মরণ করাই যায়, যেখানে উত্তম কুমার টেবিলে হাত ঠুকে বলছেন, “আই উইল গো টু দ্য টপ, দ্য টপ, দ্য টপ।” পৌঁছেছেনও, আজ অরুণ চট্টোপাধ্যায় বাঙালির প্রাণের নায়ক উত্তম কুমার।
তাঁদের বাড়ির এবং পাড়ার বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন নাটক পাগল। তাই সেই নেশা অরুণ'কেও গ্রাস করেছিল ছেলেবেলা থেকেই। কিশোর বয়সে তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সেই মাঠে নাটক করতেন। পাশাপাশি এবাড়ি-ওবাড়ি থেকে শাড়ি, বিছানার চাদর ইত্যাদি জোগাড় করে সেফটিপিন দিয়ে ঝুলিয়ে উইংস, স্ক্রীন তৈরি করে নাটকের মঞ্চ গড়তেন নিজের হাতে। প্রপ্স হিসাবে কাগজ দিয়ে মুটুক, রাংতা দিয়ে তলোয়ার তৈরির পাশাপাশি নিজেই মেক-আপও করতেন অরুণ। একদিন অরুণ ও তাঁর কয়েকজন বন্ধু মিলে বেশ কয়েকজন দর্শকের সামনে প্রথমবার প্রকাশ্যে থিয়েটার করলেন। কবিগুরুর “মুকুট” থেকে বিষয় বেছেছিলেন, থিয়েটারের নামও ছিল 'মুকুট'। উত্তম জানিয়েছেন প্রকাশ্যে “মুকুট” দিয়েই তাঁর অভিনয়ের হাতেখড়ি।
স্কুলেও বেশ সুনাম ছিল অরুণে'র। তবে তিনি নিজেকে স্বতন্ত্র রাখতে ভালবাসতেন। শিক্ষকেরাও অরুন'কে খুব ভালবাসতেন। স্কুলে বার্ষিক উৎসবের সময় এল একদিন। উৎসবে নাটকও হবে। শুনে খুব আনন্দিত হলেন অরুণ। তবে সেই নাটকে অরুণের সিনিয়ররা অভিনয় করবেন। ফলে সুযোগ নেই ছোটদের। মুষড়ে পড়লেন অরুণ। এরপর থেকে স্কুলে গেলেও পড়ায় মন বসত না, কোনও কিছুই ভাল লাগত না অরুণে'র। স্কুলের বড় দাদাদের ওপর গোঁসা করে অরুণ ভাবতেন, প্রতি শ্রেণির থেকে দুজন করে ছাত্রদের নিয়েই তো চরিত্র সাজাতে পারতেন কর্মকর্তারা। একদিন স্কুলে নিজের কক্ষে ঢুকে দেখলেন, ব্ল্যাক বোর্ডে বড় বড় হরফে লেখা আছে “গয়াসুর” নাটক হবে স্থির হয়েছে। আরও মন খারাপ গ্রাস করল অরুণ'কে।
শোনা গেল 'গয়াসুর' নাটকে ছোট গয়াসুর চরিত্রের অভিনেতা পাওয়া যাচ্ছে না, বড় বিপদে পড়েছেন নাটকের কর্মকর্তারা। কিন্তু কারুরই অরুণের কথা মাথায় এল না। আসবেই বা কেন, তখন কেই বা চিনতেন ভবিষ্যতের মহানায়ক'কে! অরুণের শ্রেণি কক্ষে হঠাৎ করে এলেন স্বয়ং তাঁর হেডমাস্টার মশাই। তাকিয়ে ছিলেন বই নিয়ে বসে থাকা অরুণের দিকে। হঠাৎ সেই রাশভারী হেড মাস্টার অরুণের দিকে এগিয়ে এলেন। ভারী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন 'কি করছ?' অরুণ বলল, 'পড়ছি স্যার।' এরপর হেড মাস্টার মশাই শুধু 'বেশ!' এই কথাটা বলে গোটা ক্লাসের প্রত্যেকে একবার দেখে নিয়ে বললেন, “তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছ যে ওই ছোট গয়াসুরের রোল টা ভালো করতে পারো?” এরপর গোটা শ্রেণি কক্ষ নিস্তব্ধ। পিন পড়লেও শোনা যায়। অরুণের বুকের ভিতরটা কাঁপছিল। তাহলে এই কি সুযোগ? সাহস জুগিয়ে অরুণ উঠে দাঁড়াল, বলল, 'পারব স্যার!' হেড মাস্টার তাঁর পিঠ চাপড়ে তাঁকে ছুটির পর মহরায় যেতে বলে চলে গেলেন।
মহরা শুরু হল, প্রথম বারেই নির্বাচিত হলেন ছোট গয়াসুরের চরিত্রে। বাড়িতে গিয়ে সবটা বললেন পরিবারের লোকদের। শুনে তাঁরা অতটাও উৎসাহিত হলেন না। এরপর মহরা চলতে থাকল। অবশেষে সেই সময় এল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম বারের জন্য অডিটোরিয়াম জোড়া দর্শক তথা বাড়ির লোকের সামনে অভিনয় করবেন অরুণ। মেক-আপ নিতে নিতে সামান্য ভয় পেয়েছিলেন তিনি। এরপর উইংসের পাশ দিয়ে অডিটোরিয়ামের দর্শক সংখ্যা দেখে ছিলেন ভয়ে ভয়ে। চারিদিকে কোলাহল, আলোয় আলোয় সাজানো চারিপাশ। মন শক্ত করলেন অরুণ। অবশেষে শুরু হল 'গয়াসুর'।
যবনিকা পতন। দর্শক ছুটে এসে ছোট গয়াসুর'কে জড়িয়ে ধরছেন। অসাধারণ অভিনয় করেছেন অরুণ। সবার ভালবাসা পেলেন। অভিনয় কৃতির জন্যে দুটি মেডেল পেলেন শিক্ষক মশাইদের থেকে। প্রথম অভিনয়ের স্বীকৃতি হিসাবে এই দুটি মেডেল সযত্নে তুলে রেখেছিলেন অরুণ। বাড়ি ফিরে মা'কে প্রণাম করেছিলেন অরুণ। বাড়ির প্রত্যেকে তাঁর এই সাফল্যে খুশি হয়েছিলেন। এরপর ধীরে ধীরে একের পর এক অভিনয় চমক দিয়ে মানুষের ধ্বনি শুনতে পান অরুণ। তাঁরা অরুণের অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে বলছেন, 'উত্তম! উত্তম!'