তপন মল্লিক চৌধুরী : তিনি এই মুহূর্তে রাজ্যের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত নাম ও চর্চিত বিষয়। তাকে ঘিরে আলোচনা যতদিন যাচ্ছে আরও বেশি করে মাত্রা পাচ্ছে। প্রায়শই তিনি নানা সভা কিংবা জনসমাবেশে উপস্থিত হচ্ছেন, রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক মঞ্চ থেকে ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করছেন। তাঁর সেই মন্তব্য ঘিরে তপ্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক বাতাবরণ। যেমন, ‘আমাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন আছে, সংকীর্ণতা আছে। আমি ভালো, তুই খারাপ।’- এই ধরণের মন্ত্যব্যে কোনও ব্যক্তি বা দলের নাম উল্লেখ না থাকলেও রাজনৈতিক বিশেষংরা ভালো-খারাপ বিভাজন বলতে তৃণমূল–বিজেপি’র মধ্যেকার তফাৎ বলেই মনে করছেন।
নবান্নে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থিত হলেন না অথচ সন্ধ্যেবেলায় তাঁকেই দেখা গেল কালী পুজোর উদ্বোধনে। এর মধ্যে দিয়ে হয়ত পরিবহণমন্ত্রীবুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি ওই বৈঠকের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপুর্ণ মনে করেন কালী কালী পুজোর উদ্বোধনে। তবে তার করা মন্তব্য যে সব সময়েই কোনও স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে এমনটাও নয়। তবে তা নিয়ে একরাশ ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়। আর রাজনৈতিক বিশেষঙ্গরা বলেন তাঁর বিজেপিতে যাওয়া আরও এক ধাপ এগলো। তার মন্তব্যের থেকে সাধারণভাবে কোনও ইঙ্গিত না বেরলেও বলা হয়, তিনি নাম না করলেও যে ইঙ্গিতপূর্ণ বার্তা দিলেন তা নিমেষে পৌঁছে যায় কালীঘাটে।
দু-এক দিনের মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী একটি কালী পুজোর উদ্বোধনে হাজির হয়েছিলেন তার খুব কাছেই উত্তর ২৪ পরগনার যুব সভাপতির বাড়ি। কিন্তু সেই অনুষ্ঠানে তিনি তো নন-ই এমনকি আঞ্চলিক স্তরের কোনও তৃণমূল নেতার মুখ দেখা যায়নি।এখান থেকে বোঝা যায় তিনি দলের সঙ্গে যত দূরত্ব বাড়াচ্ছেন, পাশাপাশি দলও তাঁর সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে। এটা অবশ্য দলীয় রাজনীতি করার স্বাভাবিক নিয়ম। এখানে কোনও ধরনের সৌজন্যতা খাটে না। বরং দল তাকে নিয়ে কি মনোভাব রাখছে সেটাই আসল কথা।
তবে কয়েকদিন আগে ঘাটালেবিজয়া সম্মিলনী অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে শুভেন্দু অধিকারী বহুদিন পর তৃণমূল, দল ও নেত্রী শব্দ তিনিটি উচ্চারণ করায় সেগুলি নিয়েযা ব্যাখ্যা হয়েছে তার মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে ভুল থাকে গিয়েছে বলেই মনে হয়। শুভেন্দু সেদিন এ ধরনের কথা বলায় অনেকে বলছেন তিনি আবেগে ভাসলেন,বহুদিন পর বললেন ‘দল’ ও ‘নেত্রী’র কথা বললেন। আসলে বুঝতে হবে বিক্ষুব্ধ শুভেন্দুগত কয়েক মাসে তৃণমূল ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম মুখে আনেন নি যে ক্ষোভ থেকে সেই ক্ষোভই উগরে দিয়েছেন ওই শব্দগুলি উচ্চারণ করে।
সেদিন কয়েকশো মানুষকে কোনও ছাউনি ছাড়া বসে থাকতে দেখে শুভেন্দুউষ্মা প্রকাশ করেন। মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা বলতে গিয়ে তিনি সেদিন যে ‘তৃণমূল’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন তা আসলে তৃণমূল স্তরের কথা। তার বক্তব্য ছিল- ‘আমি সব সময় নীচে–বসা কর্মী, তৃণমূল স্তরের কর্মী…আর তাঁর দল বলতে তিনি যে দলের কথা বলেছেন, সেই দলকেও নির্দিষ্ট করেছেন, ‘যখন আমার দল নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরে কৃষকদের লড়াইয়ে শত শত মানুষ আত্মবলিদান দিয়েছেন…’ অর্থাৎ সেদিন বিগত, আজ সেই দল আর নেই। দল বলতে তিনি এ কথাও বলেছেন, ‘তখন তো এত ভাল গাড়ি, হুডখোলা জিপ, এত বৈভব ছিল না’। তার মানে পরক্ষে তিনি আজকের প্রতিষ্ঠিত দলের সমালোচনা করছেন।
শেষে শুভেন্দু অধিকারী যে‘নেত্রী’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা বলেন সেটিও সেদিন আর এদিনের ফারাক বুঝিয়ে দেয়। সেদিন দলের জন্য তিনি কী করেছেন, তার একটি ছোট উদাহরণ দিয়ে তাঁর নিজের কি ভূমিকা ছিল সে কথা মনে করিয়ে দেন। শুভেন্দু স্মরণ করিয়ে দেন,সেদিন ওই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে লক্ষ্মণপুর গ্রামে তিনি একা ঢুকেছিলেন, সঙ্গে ছিল সরকারের দেওয়া মাত্র একজন নিরাপত্তারক্ষী। আর পুরনো কথায়‘দল’ ও ‘নেত্রী’র কথা বললেও কিন্তু এটাও মনে করিয়ে দিলেন, যে দলের জন্য শুভেন্দুর ভূমিকা কিছু কম ছিল না।
শুভেন্দু প্রকাশ্যে দল বা নেত্রীর সমালোচনা করছেন বলেই শুভেন্দু যোগের কারণেমুর্শিদাবাদের সভাধিপতির নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করা হয়। পতাকাহীন দলীয় সভায় শুভেন্দুর পাশে থাকার জন্যই যে এই ঘটনা তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কারণ, নন্দীগ্রামে শুভেন্দু আধিকারির অরাজনৈতিক সভার থাকার জন্যই শুভেন্দু ঘনিষ্ট আরও দুই তৃণমূল নেতা আবু তাহের ও মেঘনাথ পালের নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহার করা হয়েছে।