এক বাসেই কলকাতা থেকে সোজা লন্ডন! সত্যিই ছিল এই বাস পরিষেবা? ভাড়াই বা ছিল কত?

এক বাসেই কলকাতা থেকে সোজা লন্ডন! সত্যিই ছিল এই বাস পরিষেবা? ভাড়াই বা ছিল কত?

 কলকাতা: প্রতিদিন শহরের বাস টার্মিনাসগুলি থেকে হাজার হাজার বাস রওনা দেয় নিজ নিজ গন্তব্যে৷ তবে তাদের অধিকাংশেরই গন্তব্য শহরেরই কোনও এক প্রান্ত৷ কেউ কেউ আবার ছুটে যায় রাজ্যের অন্যান্য জেলায়৷ কোনও কোনও বাস আবার পাড়ি দেয় ভিন রাজ্যে৷  কিন্তু জানেন কি, এক সময় গঙ্গাপাড়ের কলকাতা থেকে বাস ছাড়া হত টেমস তীরে অবস্থিত লন্ডনের উদ্দেশে!

অবাক লাগছে? অবিশ্বাস্য মনে হলেও এই ঘটনা অনেকের কাছেই সত্যি৷ বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৫০-এর দশকে কলকাতা থেকে লন্ডনগামী এবং লন্ডন থেকে কলকাতাগামী বাস পরিষেবা চালু করা হয়।

লন্ডন থেকে কলকাতাগামী ডাবল ডেকার বাসটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অ্যালবার্ট’। কারণ, যে সংস্থা এই বাস পরিষেবা চালু করেছিল, তার নাম ছিল ‘অ্যালবার্ট ট্যুর সার্ভিস’। ১৯৫৭ সালের ১৫ এপ্রিল, লন্ডন থেকে কলকাতার উদ্দেশে রওনা দেয়  অ্যালবার্ট। মনে করা হয়, এটিই ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ বাস রুট৷ ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সময় লন্ডন থেকে কলকাতায় আসতে খরচ হত ৯ হাজার টাকা (বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায়)। তবে কলকাতা থেকে লন্ডন ফিরে যাওয়ার জন্য খরচ হত কিছুটা কম৷ টিকিটের মূল্য ছিল বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায় ৭ হাজার টাকা৷ 

পরে অবশ্য বাসের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়৷ ১৯৭৩ সালে কলকাতা-লন্ডন বাসের ভাড়া বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ১৫ হাজার টাকা (বর্তমান ভারতীয় মুদ্রায়)। 
১৯৫৭ সালে লন্ডন থেকে কলকাতাগামী বাসের প্রথম সফরে যাত্রী ছিলেন ২০জন৷ তাঁদের মধ্যে ১৩ জন কলকাতায় নেমে গেলেও সাত জন যাত্রী ওই বাসেই লন্ডনে ফিরে যান। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দু’জন মহিলা এবং পাঁচজন পুরুষ৷ বিভিন্ন প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, লন্ডন থেকে ছাড়া প্রথম বাসটি কলকাতায় পৌঁছেছিল ৫ জুন। অর্থাৎ, লন্ডন থেকে কলকাতায় আসতে বাসটির সময় লেগেছিল প্রায় ৫০ দিন৷ 

বলা হয়,  ইংল্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে বাসটি প্রথমে বেলজিয়াম এবং সেখান থেকে পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুগোস্লাভিয়া, বুলগেরিয়া, তুরস্ক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতে প্রবেশ করত। ভারতে প্রবেশের পর নয়াদিল্লি, আগরা, এলাহাবাদ, বারাণসী হয়ে এসে পৌঁছত শহর কলকাতায়৷  এই যাত্রাপথ পরিচিত ছিল ‘হিপি রুট’ নামে।

বলা হয়, দীর্ঘ এই যাত্রা পথে  প্রায় ৮ হাজার কিলোমিটার সমুদ্রপথ জাহাজে করে পেরোতে হত বাসটিকে। যাত্রীস্বাচ্ছন্দের কথা ভেবে ওই বাসে ছিল যাত্রীদের ঘুমোনোর জন্য বাঙ্ক, ঠান্ডা থেকে বাঁচতে হিটার৷ এছাড়াও সমস্ত সরঞ্জাম এবং সুযোগ সুবিধা-সহ একটি রান্নাঘরও নাকি ছিল ওই বাসের মধ্যে।

প্রাকৃতিক মনোরম শোভা উপভোগ করার জন্য বাসের উপরের ডেকে আলাদা বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রীদের আমোদপ্রমোদেরও ব্যবস্থা করা হয়৷ এর জন্য ছিল রেডিয়ো এবং একটি মিউজিক সিস্টেম৷ ভারতে প্রবেশ করার পর যাত্রীদের বারাণসীর ঘাট, তাজমহল-সহ এ দেশের একাধিক পর্যটন স্থল ঘুরিয়ে দেখাত অ্যালবার্ট ট্যুর সার্ভিস। পাশাপাশি যাত্রাপথে তেহরান, সালজবার্গ, কাবুল, ইস্তানবুল এবং ভিয়েনায় নেমে কেনাকাটার সুযোগও দেওয়া হত যাত্রীদের।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেশ কয়েক বছর ভালো মতেই চলেছিল যাত্রা৷ পরে বাসটি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে এবং সেটি সম্পূর্ণভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। পরে সেই বাসটি ব্রিটিশ পর্যটক অ্যান্ডি স্টুয়ার্ট কিনে নেন। তিনি ওই বাসটিকে একটি ভ্রাম্যমান ঘর হিসাবে পুনর্নির্মাণ করেন।

পরে নাকি আবারও বাস পরিষেবা চালু হয়েছিল। সেবার লন্ডন নয়, যাত্রা শুরু হয় সিডনি থেকে৷ ১৯৬৮ সালের ৮ অক্টোবর সিডনি থেকে ভারত হয়ে লন্ডনে পৌঁছয় অ্যালবার্ট। সিডনি থেকে লন্ডনে পৌঁছাতে বাসটির প্রায় ১৩২ দিন সময় লেগেছিল৷

 ইরান হয়ে ভারতে পৌঁছনোর পর মায়ানমার, তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া হয়ে সিঙ্গাপুরে যেত সেই বাস। সিঙ্গাপুর থেকে, বাসটিকে জাহাজে করে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে নিয়ে যাওয়া হত৷ সেখান থেকে সড়কপথে যেত সিডনি৷ এই রুটের বাসেও সমস্ত আধুনিক সুযোগসুবিধা ছিল বলে জানা যায়। ইরানের সমস্যা এবং পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে ১৯৭৬ সালে নাকি এই বাস পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

তবে এই পরিষেবা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন কলকাতার ইতিহাস নিয়ে চর্চাকারী হরিপদ ভৌমিক৷ তাঁর কথায়, ‘‘এমন একটি বাস চালু হওয়ার কথা হয়েছিল বলে শোনা যায়৷ কিন্তু তা শুরু হওয়ার কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলেনি। এই নিয়ে কোনও নথিও হাতে আসেনি।’’