প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার প্রেমের জোয়ারে নয়িকার চরিত্র পাইনি আমি: শ্রীলেখা

প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার প্রেমের জোয়ারে নয়িকার চরিত্র পাইনি আমি: শ্রীলেখা

কলকাতা: সুশান্ত সিং রাজপুতের মৃত্যু নাড়া দিয়ে গিয়েছে গোটা দেশকে৷ কেন সাফল্যের পরও ডিপ্রেশনে নিজেকে শেষ করে ফেললেন সুশান্ত? সেই প্রশ্ন বারেবারে ঘুরে ফিরে উঠছে৷ যার অন্যতম কারণ ছিল বলিউডের পক্ষপাতিত্ব৷ তবে এই সংস্কৃতি শুধু বলিউডেই নয়, রয়েছে টলিউড পাড়াতেও৷ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অভিনেতা অভিনেত্রীকে যার শিকার হতে হয়েছে৷ এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা নিজের ইউটিউব চ্যানেলে শেয়ার করলেন অভিনেত্রী শ্রীলেখা মিত্র৷ জানালেন নিজের ডিপ্রেশনের কথাও৷  শ্রীলেখা বলেন, ‘‘একটা সময় কাজের জগত এবং ব্যক্তিগত জীবনে একা হয়ে গিয়েছিলাম৷ ডিপ্রেশনে ছিলাম৷ কিন্তু আমি আত্মহত্যাপ্রবণ নই। এর সঙ্গে বহু বছর ধরে ফাইট করছি৷ করব৷’’  

শ্রীলেখার ছেলেবেলা কেটেছে দমদম ক্যন্টনমেন্টে৷ যেখানে শহুরে দুনিয়ার ছাপ ছিল না৷ অক্সিলিয়াম কনভেন্টে পড়াশোনা তারঁ৷ এর পর জয়পুরিয়া কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন৷ অ্যাডভার্টাইজিং, পাবলিক রিলেসন নিয়ে ডিপ্লোমা কোর্সও করেছেন৷ ছোট থেকেই বই পড়ার ঝোঁক তাঁর৷ তাই অন্যান্য পেশার পথ খোলা থাকলেও, তিনি চেয়েছিলেন অভিনয় করতে৷ কিন্তু কোনও কিছুর সঙ্গে আপোষ করতে পারেননি তিনি৷ তাই এই পরিণতি৷ ডিপ্রেশনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ডিপ্রেশন এমন একটা অসুখ যা মানুষকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়৷’’  

শ্রীলেখা বলেন, ‘‘ক্যামেরার সামনে অভিনয়টা ভালো করলেও, ক্যামেরার পিছনে অভিনয়টা আমার আসে না৷ এর দাম আমাকে প্রতিনিয়ত দিতে হয়েছে৷ এই লাইভ ভিডিয়োর পরে আরও দিতে হবে৷ তবে আমি একজন ফাইটার৷ হেরে যাওয়ায় পাত্রী নই৷’’অভিনেত্রী বলেন, এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার কেউ নেই৷ কোনও দিন ছিলও না৷ আর এখানেই সুশান্তের সঙ্গে নিজেকে অনেকটাই মেলাতে পেরেছেন শ্রীলেখা৷ তিনি বলেন, ‘‘কাজের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এখানে এসেছিলাম৷ তাবেদারি করে নয়৷ শুরুটা হয়েছিল ওড়িয়া ছবি থেকে৷ তারপর সিরিয়াল৷ এই ভাবে ধাপে ধাপে এগোচ্ছিলাম৷’’ তাঁর কথায়, সেই সময় সিনেমা জগত একটু টালমাটাল ছিল৷ হিরো বলতে ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়৷ তখন সুযোগ পাওয়া অনেক কঠিন ছিল৷ যার কোনও গড ফাদার ছিল না, তার ক্ষেত্রে এই স্ট্রাগলটা আরও বেড়ে যেত৷  

ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা পাওয়ার গেম চলে৷ শ্রীলেখা বলেন, “যে প্রযোজক-পরিচালক বা স্বনামধন্য নায়কের কাছে ক্ষমতা আছে, তিনি তাঁর ব্যবহার করেন। সুন্দরী মহিলারা যদি নিজেদের অস্তিত্বের জন্য লড়াই করে, সেটা মেনে নিতে পারে না ইন্ডাস্ট্রি৷ সেদিক থেকে প্রথম দিন থেকেই আমি মিস ফিট ছিলাম।” শ্রীলেখা বলেন, ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর সঙ্গে তখন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের প্রেম৷ ইন্ডাস্ট্রিতে রাজত্ব করছেন বুম্বা দা৷ বুম্বা দা এবং ঋতুপর্ণার ডেট নেওয়ার জন্য লাইন দিয়ে বসে থাকতেন ডিরেক্টর-প্রোডিউসাররা৷ বুম্বাদার একটা আলাদা চেয়ার থাকত। আমি দেখতাম বুম্বাদা চেয়ারের উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। কিন্তু পরিচালকরা মাটিতে বসে তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন। আবার ঋতুপর্ণা হামেশাই দেরি করে শ্যুটিংয়ে আসত৷ সবাই ওঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকত৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ওঁকেই নেওয়া হত ছবিতে৷ আর আমাদের প্রমাণ করতে হত, আমরা কতটা পাংচুয়াল৷ ছবি চলুক আর নাই চলুক প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটি। এই জুটি ভাঙবার নয়।’’

শ্রীলেখা বলেন, ‘‘কখনও বোনের চরিত্রে, কখনও সেকেন্ড লিড করেছি৷ নায়িকা হওয়ার যোগ্যতা থাকলেও, সেই সুযোগ পাইনি৷ ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে টেলিভিশনে কাজ করেছি৷ তবে টেলিভিশন অনেক ভালো ভালো কাজ দিয়েছে৷’’ এর পর ছোট পর্দায় অনেক কাজ করেছেন শ্রীলেখা৷ অভিনেত্রী বলেন, ‘‘আমি জীবনে কোনও দিন জুটি বাঁধতেই পারিনি৷ প্রথমে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা, তারপর প্রসেনজিৎ-অর্পিতা, জিৎ-স্বস্তিকা, স্বস্তিকা-পরমব্রত ইত্যাদি৷’’ তাঁর কথায়, যে নায়িকার সঙ্গে নায়কের প্রেম ছিল তাঁরা জুটি হিসেবে কাজ পেতেন। এটা যেন প্যাকেজ ডিল ছিল।’’ ‘‘আমার কোনও দিনই কোনও হিরো, ডিরেক্টর বা প্রোডিউসারের সঙ্গে প্রেম হয়নি৷ তাই কোনও গডফাদারও পাইনি৷ তার উপরে আমি সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে ভালোবাসি। মহিলা হওয়ার আলাদা কোনো সুবিধা নিতে পছন্দ করি না৷ ফলে আমাকে কাজ দেবে কে?’’ বললেন শ্রীলেখা৷

এর পর এসকে ফিল্মসের অশোক ধনুকার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসে৷ শ্রীলেখা বলেন, “সাগর বন্যা ছবির শুটিংয়ে আমরা দীঘা যাচ্ছিলাম। ওই ছবিতেই ছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রানী হালদার। আমার গাড়িতে আমি ও আমার মা ছিলাম। তখন একটি অ্যাক্সিডেন্ট হয়। আমরা দীঘা হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে ছবির পরিচালক আমাদের দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় দেখতে আসার সময় পাননি। কারণ আমি তো তখন কেউ নই৷ এই দুর্ঘটনার পর মা ভালো করে হাঁটাচলাও করতে পারত না৷ সেই সময় ইউনিটের কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাইনি৷ সবটাই নিজেকে করতে হয়েছে৷’’

বাংলাদেশের কোলাবরেশনে এই ছবিটি প্রযোজনা করছিলেন অশোক ধানুকা৷ কিন্তু দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়ার ছবি থেকে বাদ পড়েন শ্রীলেখা৷ তিনি বলেন, ‘‘আমার মনে আছে সাইনিং অ্যামাউন্টের বদলে একটা বড় হরলিক্সের শিশি নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন অশোক দা৷ তবে তিনি কথা দিয়েছিলেন, একার প্রযোজনায় ছবি করলে তাঁকে নায়িকার চরিত্রে নেবেন। ’’ শ্রীলেখা জানান, এরপরে অশোক ধানুকার ‘অন্নদাতা’ ছবিতে নায়িকার চরিত্রে সই করেন তিনি। ১০১ টাকা দিয়ে সই করান অশোক দা৷ প্রথম বাংলা ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে খুবই আনন্দিত ছিলেন তিনি। কিন্তু পরে অশোক ধানুকা ফোন করে জানান, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সঙ্গে ছবি করতে চান না। কারণ তিনি মনে করেন শ্রীলেখা নায়িকা হলে কেউ টাকা দিয়ে সিনেমা হলে যাবেন না। শ্রীলেখা জানান, এর পরে একদিন স্টুডিওতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়কে দেখে এড়িয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বদলে ফিরদৌসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এবং তার কিছুদিন পরেই অশোক ধানুকা এবং খোদ প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ফোন করে জানান, অন্নদাতা ছবিতে শ্রীলেখাই কাজ করছেন।

শ্রীলেখা জানান, ‘অন্নদাতা’ ছবিটি বাম্পার হিট করেছিল। কিন্তু তারপরে আর কোনও ছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করা হয়নি। ‘অন্নদাতা’ ছবিতে একটি গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স ছিল অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়ের। তখন থেকে প্রেম শুরু হয় অর্পিতা ও বুম্বাদার। অনেক সময় হয়েছে৷ অনেকেই ফোন করে বলেছে, নারে বাবু তোকে নিতে পারব না৷ ঋতু ছবিটা করবে৷ ও খুব কান্নাকাটি করছে, এমন সব কথা৷ এরপরে অর্জুন চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘টলিলাইটস’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেন শ্রীলেখা। অভিনেত্রীর কথায়, “সেই সময় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত অর্জুন চক্রবর্তীকে ফোন করে বলেছিলেন, শ্রীলেখা কে বাদ দাও। আমাকে দাও। আমি কম পারিশ্রমিক অভিনয় করব। ডেটও দিয়ে দেব৷ সেই সময় খুব কষ্ট হয়েছিল। মনে হয়েছিল, অন্য কোনও প্রফেশন খুঁজতে হবে? কিন্তু অর্জুনদাকে ধন্যবাদ জানাই যে, উনি আমাকে ছবিটা করতে দিয়েছিলেন।’’ ঋতুকে পরে শ্রীলেখা বলেছিলেন, তোমার হা মুখটা ছোট করো। সব খাবো করোনা না৷ অন্যদেরও কাজ করতে দাও। তোমার বছরে অনেক ছবি রিলিজ করে৷ আমি যে ছবিগুলো করি, সেগুলো করতে দাও৷ অন্তত নিজের মেরিটে কাজ করার সুযোগ দাও৷
শ্রীলেখা বলেন, “আমরা অনেকেই অনেক সময় সমালোচনা করি। কিন্তু আমি কখনও ঋতুকে কোনও খারাপ কথা বলতে দেখিনি। ও ভীষণ চালাক। ও সবার সঙ্গে, যে কোনো বয়সের  পুরুষ-নারীকে খুব মিষ্টি করে কথা বলে মোহিত করে দিতে পারে।”

এমনকি শ্রীলেখা জানাচ্ছেন বড় প্রযোজনা সংস্থা না হলে সেই ছবি ইচ্ছাকৃত ভাবেই চলতে দেওয়া হয় না। তার কথায়, “নেপোটিজম ছিল রয়েছে এবং থাকবে।” আর কৌশিক গাঙ্গুলীর ছবিতে শুধু চূর্ণী গঙ্গোপাধ্যায় কাজ করবেন। সেটা নিজেই কৌশিকদা তাঁকে বলেছিলেন। ‘‘তবে জয়া আহসান বোধহয় খুব ভালো অভিনেত্রী। তাই জয়া আহসান তাঁর ছবিতে কাজ পান৷ কিন্তু  আমি পাইনা।’’ সৃজিত মুখোপাধ্যায় প্রসঙ্গে শ্রীলেখার বক্তব্য, “আমি জানি সৃজিত লাইভ ভিডিওটা দেখছে। একসময় আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল সৃজিত। কিন্তু ও যখন ছবি করল, তখন আর আমাকে ডাকেনি। হয়তো আমার উপযুক্ত কোনও চরিত্র ছিল না। স্বস্তিকার মতনই চরিত্রগুলো ছিল। আসল কথাটা হল স্বস্তিকার সঙ্গে তখন সৃজিতের প্রেম চলছিল।”

শ্রীলেখা বলেন, আমি কি যোগ্য ছিলাম না? আমি যোগ্য ছিলাম, হিট ছবি দিয়েছি৷ তার পরেও কাজ পাইনি৷ এই ইন্ডাস্ট্রিতে আর কোনও সুশান্ত সিং রাজপুত যেন আত্মহত্যা না করে৷ ইন্ড্রাস্ট্রির মাথাদের কাছে তাঁর বিনীত আর্জি, প্রত্যেকটা ইউনিটে একজন করে মনস্তত্ববিদ যেন থাকেন৷ এখানে অনেক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে৷ প্রত্যেকটা মানুষের প্রাণের দাম আছে৷  শ্রীলেখার কথায় “আমার মুনমুন সেন, অপর্ণা সেনের মত কোনও মা নেই। আমার রঞ্জিত মল্লিক, সন্তু মুখোপাধ্যায়ের মত কোনও বাবাও নেই। শুধু সিনেমা নয়, একই রকম হয়েছে সিরিয়ালেও৷ শ্রীলেখা বলেন,  “অঞ্জনা বসু এবং গার্গী রায়চৌধুরী সঙ্গে প্রযোজকের প্রেম হয়েছিল বলে আমার সিরিয়ালের অংশ অনেক কমে গিয়েছিল।’’ এমনকি শ্রীলেখা এও বলেছেন, “শ্রীলেখা মিত্রকেও কি আত্মহত্যা করে প্রমাণ করতে হতো, তিনি কষ্টে আছেন?” তিনি বলেন, ‘‘আমার মৃত্যুর পর কোনও রকম মিডিয়া সার্কাস হবে না৷ আমার মৃতদেহ নিয়ে কোনও রকম প্যানেল বসবে না৷ বরং যাঁরা আমার কাছের মানুষরা তাঁরা আমার মৃত্যুকে সেলিব্রেট করবে৷’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *