কলকাতা: এ যেন দার্শনিক ফ্রানজ কাফকার প্রতিফলন। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁর সৃষ্টি ধ্বংস করা হয়। সেই একই সুর এবার কবীর সুমনের গলাতেও। তিনিও জানিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁর সৃষ্টির কোনও নিদর্শন না রাখা হয়। এমনকী বাদ্যযন্ত্র এবং রেকর্ডিংও নষ্ট করে ফেলার অনুরোধ করেন সুমন। ফেসবুকে তিনি প্রকাশ করেছেন তাঁর লেখা একটি চিঠি। সেখানেই এই ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তিনি।
সপ্তমীতে এই ঘোষণা করেন কবীর সুমন। সুমনের অনুরাগীরা তো বটেই, আমআদমিও এই পোস্ট পড়ে বেশ হতবাক। পোস্টে কবীর সুমন লিখেছেন, “সজ্ঞানে, সচেতন অবস্থায়, স্বাধীন ভাবনাচিন্তা ও সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে আমি জানাচ্ছি: আনার কোনও অসুখ করলে বা আমায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে অথবা আমি মারা গেলে আমার সম্পর্কিত সবকিছুর, প্রতিটি বিষয় ও ক্ষেত্রে দায়িত্বগ্রহণ এবং সিদ্ধান্তগ্রহণের অধিকার থাকবে একমাত্র মৃন্ময়ী তোকদারের (মায়ের নাম প্রয়াত প্রতিমা তোকদার, বাবার নাম দেবব্রত তোকদার)। অন্য কারুর কোনও অধিকার থাকবে না এইসব বিষয় ও ক্ষেত্রে। আমার মৃতদেহ যেন দান করা হয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাজে। কোনও স্মরণসভা, শোকসভা, প্রার্থনাসভা যেন না হয়। আমার সমস্ত পাণ্ডুলিপি, গান, রচনা, স্বরলিপি, রেকর্ডিং, হার্ড ডিস্ক, পেনড্রাইভ, লেখার খাতা, প্রিন্ট আউট যেন কলকাতা পুরসভার গাড়ি ডেকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সেগুলি ধ্বংস করার জন্য- হাতে লেখা সবকিছু, অডিও ও ভিডিও ফাইল- সব। আমার কোনও কিছু যেন আমার মৃত্যুর পর পড়ে না থাকে। আমার ব্যবহার করা সব যন্ত্র, বাজনা, সরঞ্জাম যেন ধ্বংস করা হয়। এর অন্যথা হবে আমার অপমান।”
কিন্তু কেন এই পোস্ট? তা স্পষ্ট জানাননি কবিয়াল। কিন্তু ইচ্ছাপত্রে তিনি এও লিখেছেন, “খুব জরুরি বিষয়। আবেগহীনভাবে সকলকে জানিয়ে রাখছি, কারণ হঠাৎ কিছু ঘটে গেলে কঠিন সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় অনুরূপ একটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল ২০১২ সালে আমি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হবার পর। খোলাখুলি সকলকে জানিয়ে রাখছি। অনুগ্রহ করে মতামত দেবেন না। ভাল মন্দ কিছু লিখবেন না। এটা এক প্রবীন মানুষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি। অনেক অভিজ্ঞতার পর, অনেক ভেবেচিন্তে লিখছি। ফেসবুকে, যাতে অনেকেই এটা জেনে যান। অনুগ্রহ করে আবেগের বশবর্তী হবেন না, উপদেশ পরামর্শ দেবেন না। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি, যাবো। আমার জীবনে কোনও হতাশা, দু:খ, ব্যর্থতাবোধ, অবসাদ নেই। আমি সানন্দে বেঁচে আছি, আমার কাজ করে যাচ্ছি। আমার জীবনে ভালবাসা কামনা কাম লালসা আনন্দ স্ফুর্তি মজা রঙ্গরগড় হাসাহাসি নিভৃত কান্না কাজ অধ্যবসায় নিয়মিত রেয়াজ পরিশ্রম সৃজনশীলতা সবই আছে। প্রয়াত খুশওয়ান্ত সিং তাঁর ‘ দি এণ্ড অফ ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছিলেন – “কাজই ধর্ম”। আমি তাইই মনে করি। আমার ধর্ম কাজ। প্রতিনিয়ত আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি, অর্থাৎ স্বধর্ম পালন করছি। আমি জানি আমি সানন্দে,খুশি মনে মারা যাবো। আমি বেঁচে আছি বাংলা খেয়াল বাংলা গান সুরতালছন্দলয়, আমার স্বভাবসিদ্ধ ভালবাসা কাম কামনা খামখেয়ালিপনা inconsistency এক ধরণের ক্ষ্যাপামি আর সুরতাললয়ে থেকে মৃত্যুর অপেক্ষায়। অন্য কোনও বিষয়ে আমি নেই।” এই ফেসবুক পোস্টের নীচে লিখেছেন, ‘জন্মস্বাধীন। স্বপরিশ্রমে ও স্বখরচায় স্বেচ্ছাচারী, কবীর সুমন’।