তপন মল্লিক চৌধুরী: একবার হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় খবর দিলেন, রায় সাহেব তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। মনের মধ্যে প্রবল খুশী আর উত্তেজনা নিয়ে ছুট লাগালেন। থামলেন এসে হোটেলের রিসেপশনে। জিজ্ঞেস করতেই রিসেপশনিস্ট জানিয়ে দিল, উনি লনে বসে আছেন। ডান-বা করে সবুজ লনের সামনে যেতেই চেহাড়াটা দূর থেকেই চোখে পড়ল। পায়ে পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই গভীর খাদ থেকে একটি মাত্র শব্দ বেজে উঠল, ‘গুলজার’!
গলার স্বরটা পরিচিত তবু একটু অবাক হলেন, সত্যজিৎ রায়ও তাঁকে একই নামে ডাকলেন বলে। গুলজার যেন সেই মুহুর্তে একটু লাজুক, বললেন, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, মানে…’। সত্যজিৎ রায় বললেন, ‘Yes, I was to complement you. Every one had told me about you.’
সেই প্রথম সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে গুলজারের মুখোমুখি কথালাপ। তিনি লিখেছেন, অত ভাল ইংরেজি যে কেউ বলতে পারে না। শুধু গলার আওয়াজ থাকলেই হয় না, উচ্চারণের সঙ্গে শরীর আর মুখের অভিব্যক্তি একশোভাগ ইংরেজের মতো। কিন্তু সেই লোকটাই যখন বাংলা বলছেন, তখন একেবারে চেনা বাঙালি।
সত্যজিৎ রায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ হিন্দিতে করতে চেয়েছিলেন। জানতেন হিন্দির জন্য গুলজার উপযুক্ত লোক। তাই ছবির চিত্রনাট্য আর গান নিয়ে গুলজারের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন। উৎসাহী গুলজার খবর পাওয়ামাত্র ছুটে এসেছিলেন। তাঁর অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার। গুগাবাবা-র চিত্রনাট্য,গানের ভাষা নিয়ে দু’জন সেদিন অনেক কথাই বলেছিলেন। সত্যজিৎ রায় গুলজারের হিন্দিতে খুব আশ্বস্ত হয়ে গুপি গাইন বাঘা বাইনের স্ক্রিপ্ট দেখে গানগুলো নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু গুগাবাবা হিন্দিতে হয় নি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে গুলজারের কাজ করার প্রথম সুযোগটা মাঠে মারা যায়। শুধু তাঁর হাতে লেখা সেই গানের কাগজগুলি গুলজারের কাছে অমূল্য স্মারক হিসেবে রয়ে যায়।
কিন্তু সৌভাগ্যবশত দ্বিতীয়বার গুলজার সত্যজিত রায়ের সঙ্গে কাজ করার একটা সুযোগ পেয়ে গেলেন। দিল্লি দূরদর্শনে প্রফেসর শঙ্কুর গল্প নিয়ে হিন্দিতে সিরিয়াল করতে চাইলেন সত্যজিৎ রায়। চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব সেই গুলজারকেই দেওয়া হল। কিন্তু এবারও ভাগ্য প্রসন্ন হল না। কিছুদিন পর গুলজার খবর, সিরিয়ালটি হবে না। সুযোগ তৈরি হলেও দ্বিতীয়বারও সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে গুলজারের কাজ করা হল না!
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে যখন একেবারেই দমে গিয়েছে তখন ফের একটা সুযোগ পেলেন গুলজার। যদিও এবার আর সত্যজিৎ রায় নিজে খবর পাঠাননি অথবা গুলজারের নাম প্রস্তাব করেন নি। তবে গুলজার সুযোগ নিজেই তৈরি করার চেষ্টা করলেন। গুলজার খবর পেলেন 'শতরঞ্জ কে খিলাড়ি' সিনেমা তৈরি করবেন সত্যজিৎ রায়। তৃতীয়বারের মতো নিজেই ছুটে গেলেন গুলজার।
হোটেলে গিয়ে গুলজার শুনলেন, সত্যজিত রায় কলকাতা ফিরবেন বলে এয়ারপোর্ট বেরিয়ে গিয়েছেন। ট্যাক্সি নিয়ে এয়ারপোর্টে ছুটলেন গুলজার। সোজা সত্যজিতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘ মানিকদা, আমি শতরঞ্জ কে খিলাড়িতে কাজ করতে চাই। স্ক্রিপ্ট লিখব’। মানিকদা বললেন, ‘কিন্তু তুমি তো দেরি করলে। চিত্রনাট্য লেখার কাজ তো আমি অন্য একজনকে দিয়ে দিলাম’।নিজের কাজের জগতে প্রায় একশো ভাগ সফল মানুষ গুলজারের সারা জীবনে হয়ত একটা কষ্ট মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, মানিকদার সঙ্গে তাঁর কাজ করা হয়নি।