ছিলেন জনপ্রিয়, বিতর্কিত! শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিনে একটি না শোনা গল্প

ছিলেন জনপ্রিয়, বিতর্কিত! শিল্পী দেবব্রত বিশ্বাসের জন্মদিনে একটি না শোনা গল্প

তপন মল্লিক চৌধুরী: দেবব্রত বিশ্বাসকে নিয়ে গল্পের অভাব ছিল না কোনওদিন। যখন তিনি জীবিত তখন তো কানাঘুষো ছিলই, বিশেষত তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া নিয়ে বিশ্বভারতীর তীব্র আপত্তির পর তাঁকে নিয়ে বহু গল্প বাজারে চাউর হয়। মৃত্যুর পর তাঁর রেকর্ড পরবর্তীতে তাঁর গাওয়া গান নিয়ে ক্যাসেটের তুমুল ব্যবসার পাশাপাশি নতুন নতুন গল্পও তৈরি হতে থাকে। কিছুদিন পর সেসব চাপা পাড়ে যায়। ফের শুরু হয় ২০১১ তে তাঁর জন্মশতবার্ষিকীতে।

ওই বছর এক দাদার কাছে শোনা দু’একটি ঘটনার কথা এখানে বলার চেষ্টা করছি। তিনি দেবব্রত বিশ্বাসের সান্নিধ্যে ছিলেন বেশ কয়েক বছর। সেই দাদা এবং তাঁর আরও কয়েকজন বন্ধু একবার ঠিক করলেন দেবব্রত বিশ্বাসের সঙ্গে আলাপ করবেন পরবর্তীতে চেষ্টা করবেন ওঁকে দিয়ে একটি অনুষ্ঠান যদি করানো যায়। কিন্তু পৌঁছবেন কিভাবে। বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাসের ইনকাম ট্যাক্স কনসালটেন্ট। সেই বিশুদাকে ধরে তাঁরা রাসবিহারী অ্যাভিনিউর ওই ঘর পর্যন্ত পৌঁছলেন ঠিকই কিন্তু বসেন বসেন…কোথায় থাকেন…কী করেন…ইত্যাদিতেই শেষ হল আলাপ। মানে ঠিক জমলো না।

তাঁরা দমে না গিয়ে ধরলেন সন্তোষ সেনগুপ্তকে। দু’জনে এক সময়ে একই কলেজে পড়তেন এবং একই মেসে রুম শেয়ার করে থাকতেন। পাড়ার ছেলেদের অনুরোধ সন্তোষ সেনগুপ্ত এরাতে পারলেন না। একদিন সকালে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন তাদের। সন্তোষ সেনগুপ্ত ঘরে ঢুকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এঁরা আপনাকে নিয়ে একতা অনুষ্ঠানের কথা ভাবছেন। দেবব্রত বিশ্বাস শুনে বললেন, ‘ও আগের দিন বিশু বাবুর সঙ্গে এসে বুঝলেন সুবিধা হয়নি, তাই এবার সন্তোষবাবু। তো অনুষ্ঠান কবে?’ ঘটনাটি মনে আছে দেখে ওঁরা একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে জানালেন, ‘সামনের মাসের ১৪ তারিখ’।

দেবব্রত বিশ্বাস ওঁদের আশ্বস্ত করে বললেন, ‘আমি কথা দিলাম যাব, তবে কিনা আর্টিস্ট কনফার্ম হবে ১২ তারিখ সকালে’। ওঁরা ঠিক বুঝলেন কি না; এরপরেই দেবব্রত বিশ্বাস জানান, ‘আমার শরীরটা তো ভাল থাকে না, তাই ১২ তারিখ সকালে এসে একবার খবর নিয়ে যান, যদি দেখেন ভাল আছি তো এখান থেকেই চলে যান আনন্দবাজার অফিস। একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে দেন…১৩ তারিখ সকালে বিজ্ঞাপন বেরলে কাউন্টার খোলার ঘন্টা চারেকের মধ্যে হাউসফুল’। একথা শুনে তো ওঁরা স্তম্ভিত। লোকটা বলে কী!

দেবব্রত বিশ্বাস ওদের চোখ-মুখ দেখে ফের বললেন, ‘আরে ওই যে আপনারা লেখেন না-রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক বিতর্কিত শিল্পী কিংবা বিশেষ শিল্পী…ওইভাবেই দিয়ে দেবেন’। তখন অনুষ্ঠানে যেতে রাজি হলে দেবব্রত বিশ্বাস খুব বেশি হলে দুটি গান গাইতেন। আর বিজ্ঞাপনে অনেক শিল্পীদের নামের শেষে ওই কথাটাই লেখা থাকত। আর তাতেই প্রেক্ষাগৃহ ভরে যেত বিতর্কিত অথবা বিশেষ শিল্পীর কারনে।

বন্যাত্রাণ সংগ্রহে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর রবীন্দ্র সদনে একটি একটি অনুষ্ঠান করেছিল। বহু অনুরোধে দেবব্রত বিশ্বাস সেই অনুষ্ঠানে গাইতে রাজি হয়েছিলেন। কলকাতা দূরদর্শনের ক্যামেরা হাজির ছিল সেই অনুষ্ঠানে। মঞ্চে যখন দেবব্রত বিশ্বাস ‘আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ ধূলার পরে’ গাইছেন তখন দু’তিনটি সানগান জ্বলে ওঠে। দেবব্রত বিশ্বাসের গান থেমে যায় কিন্তু তিনি হারমোনিয়াম বাজিয়ে চলেন। এইভাবে চলতে চলতে কয়েক মিনিট পেরয়। কিন্তু কার্যকারণ বুঝে উঠতে পারেন না বহু শ্রোতা এমনকি অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা। কিন্তু কিছু শ্রোতা তাঁর মেজাজ মর্জি জানতেন বুঝতেন। তাঁরা চিৎকার করে ক্যামেরা এবং সানগান বন্ধ করতে বলেন। দু-একজন দূরদর্শনের ক্রিউ এবং উদ্যোক্তাদের গিয়েও অনুরোধ করেন। সানগান নিভিয়ে দিয়ে ক্যামেরায় ছবি তোলা বন্ধ হতেই ফের শুরু হয়ে যায় গান।

সেদিনও দেবব্রত বিশ্বাসের ওই অনুষ্ঠানের সঙ্গী ছিলেন আমার ওই দাদা। তাঁর গুরু নিজের প্রচার ওভাবে থামিয়ে দেওয়ায় বেশ দমেই গিয়েছিলেন। ফেরার পথে জিঙ্গেস করেছিলেন, ‘আপনি গান থামিয়ে দিলেন কেন, চোখে আলো পরছিল বলে?’ দেবব্রত বিশ্বাস বললেন, ‘না’।

-তাহলে?
-কি গাইছিলাম?
-আমার মাথা নত করে দাও হে…
-তার পরের লাইন কি?  
– তোমার চরণ ধূলার পরে
-তখন কি গাইছিলাম?
-নিজেরে যেন না করি প্রকাশ আপন কাজের মাঝে

 

দেবব্রত বিশ্বাস বললেন, ‘গাইব নিজেরে যেন না করি প্রকাশ আর আলো জ্বালিয়ে ছবি তুলে সকলকে দেখাব, দুটো কাজ একইসঙ্গে কিভাবে করি?’
আসলে দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রসঙ্গীত শুধু গাইতেন না, নিজের জীবনে লালন করতেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *