শ্রীমান অপূর্ব, কবি, নাট্যকার, সম্পাদক, চিত্রকর, সাহিত্যিক ও শিল্পীকে শ্রদ্ধা

শ্রীমান অপূর্ব, কবি, নাট্যকার, সম্পাদক, চিত্রকর, সাহিত্যিক ও শিল্পীকে শ্রদ্ধা

 

তপন মল্লিক চৌধুরী : প্রায় ছ’দশক ধরে তিনি অভিনয়ের শাখা প্রশাখায় পথ চলেছেন বিরামহীন। থিয়েটার থেকে সিনেমা, টেলিভিশন- মানুষের জীবনে যত রকম চরিত্র হতে পারে; সমস্ত ধরণকেই তিনি রূপ দিয়েছেন।তিনি অভিনেতা হিসেবে পরিচিত হলেও বাঙালি দর্শক তাঁর বহুমুখী প্রতিভার সঙ্গে পরিচিত। অভিনয় তাঁর পেশা হলেও কেবলমাত্র সেই কাজেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। তিনি কবি, নাট্য ব্যক্তিত্ব, সম্পাদক এবং চিত্রকর- সাহিত্য ও শিল্পের প্রায় সমস্ত শাখাতেই তিনি বিচরণ করেছেন অবাধে। এই সব কাজে তাঁর যে উৎসাহ এবং উদ্যম সেটা খুব কম বাঙালির থাকে, আর খুব কম মানুষ তা সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ করতে পারে।

বয়স তাঁকে পর্যুদস্ত করতে পারে নি। ওটা ছিল তাঁর কাছে একটা সংখ্যা মাত্র। তবু যে বয়সে সাধারণমানুষকাজেরশক্তিহারিয়ে ফেলেসেইবয়সে যেন তিনি নতুন করে শুরু করতেন।  তাঁর ভাষায় জীবনের নানা বাঁকে যেমন নানা ওঠা পড়া কাজের ক্ষেত্রেও তেমনই নানা ধরণ সে পড়ে। তাঁকে নানা সাজে সাজিয়েছেন সত্যজিৎ রায়। কখনো অপু, কখনো ফেলুদা। সমসাময়িককালে তিনিই একমাত্র অভিনেতা যিনি একটানা কয়েক দশক ধরে তুমুল জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। জন্ম থেকে শৈশব কাটিয়েছেন নদিয়ার কৃষ্ণনগরে। হাজারো স্মৃতি সেই অঞ্চল নিয়ে। বাবার বদলির সঙ্গে বদল হতে থাকে স্কুল। হাওড়া জেলা স্কুলে মাধ্যমিক, মাঝে কিছুদিন দার্জিলিং এরপর কলকাতার সিটি কলেজ। এই সব জায়গা-জমি-মানুষের কথা তিনি নানাভাবে বলেছেন।  

নিজের শৈশব প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘…আমার বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় পেশা হিসেবে ওকালতি বেছে নিলেও তিনি মগ্ন থাকতেন কবিতা নিয়ে। পছন্দের কবিতা তিনি আমাদের আবৃত্তি করে শোনাতেন। বাবাই আমাকে ধরে ধরে আবৃত্তিটা শিখিয়েছেন। আবৃত্তির মতো অভিনয়ে আসাটাও আমার উকিল বাবার হাত ধরেই। আমাদের কৃষ্ণনগরের বাড়িতে আমার পিতামহের আমল থেকেই নাটক হত। বাবা কলকাতায় ওকালতি করতেন। তিনি কলকাতা থেকে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি ফিরতেন, তখন উৎসব লেগে যেত। বাড়ির সব ছেলেমেয়েরা মিলে তখন নাটক করতাম।’

অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ১৯৫৯ সালে সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিনয়ের অনেক আগেই নাট্যচর্চার সঙ্গে তিনি জড়িত হন। এ বিষয়ে তিনি বলেন,  ‘…কলেজে পড়ার সময়টাতে আমি নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ীর সংস্পর্শে আসি। অভিনয়ের ব্যাকরণ শেখা তার কাছ থেকেই। গিরিশ যুগের অবসান আর নবনাট্য আন্দোলনের সেতু বন্ধনকারী শিশির কুমার ভাদুড়ী আমার চেতনাকে কাঁপিয়ে দিলেন। সেই চেতনা থেকেই এখনো থিয়েটার করছি। থিয়েটারের ওই ঘোরের মাঝেই দেখা হয়ে গেল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। জায়গা হল বিশ্ব সংসারের মতোই ‘অপুর সংসার’ চলচ্চিত্রে। তারপরে আমার জীবনতো শুধু আর আমার রইল না। একজন সাধারণ সৌমিত্র ছড়িয়ে পড়লো, এক আমি হয়ে গেলাম অনেকের।’

সত্যজিৎ রায়ের ৩৪টি ছবির মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়অভিনয় করেছেন ১৪টিতে।ওই বিষয়ে অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘… এই মহান মানুষটির সঙ্গে যতোক্ষণ কাজ করতাম, একধরনের ঘোরের ভেতর থাকতাম আমি। সময় যেন থমকে যেত। কখন বেলা গড়িয়ে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে যেত টেরই পেতাম না। এখানে একটু বলে রাখি যে, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে পরিচয়ের সাথে সাথেই কিন্তু আমার চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু হয়নি। ওইসময় তিনি পথের পাঁচালির দ্বিতীয় পর্ব ‘অপরাজিতা’ বানাচ্ছেন। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেন তার ‘পরশপাথর’ আর ‘জলসাঘর’ চলচ্চিত্রের অভিনেতা ছবি বিশ্বাস।…আমি প্রায়ই ‘অপরাজিতা’ ছবিটির শুটিং দেখতে যেতাম। বড় ভাল লাগত। একদিন সত্যজিৎ রায় বললেন, ক্যামেরার সামনে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা কিভাবে অভিনয় করে সেটা মন দিয়ে দেখার জন্য। কেন বলেছিলেন,সেটা ওইসময় বুঝতে পারিনি। ওই ছবির শুটিং শেষ হওয়ার পর শুনলাম তিনি পথের পাঁচালি নিয়ে আরেকটি সিক্যুয়েল ‘অপুর সংসার’ বানানোর পরিকল্পনা করছেন। মনের মধ্যে তার ছবিতে কাজ করার ইচ্ছে আমার আগেই ছিল। কিন্তু অপু’র জন্য তিনি যে আমাকে বেছে নেবেন, এমনটা ভাবিনি। কারণ আমার বয়স তখন ছিল ২৩। অপু’র বয়স থেকে আমার বয়স বছর দুয়েক বেশি। ছবি বিশ্বাসের মুখ থেকে যখন শুনলাম আমাকেই মানিকদা (সত্যজিৎ রায়ের ডাক নাম) বেছে নিয়েছেন, বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এরপর একে একে তার চৌদ্দটি ছবিতে কাজ করার সৌভাগ্য হল’।

যে থিয়েটার থেকে তিনি শুরু করেছিলেন তাকে কখনোই তিনি ভুলে থাকেননি। সিনেমায় তুমুল ব্যস্ত থাকার দিনগুলোতেও তিনি থিয়েটারে অভিনয় করেছেন।বয়স যখন আশির কোঠা পেরিয়েছে তখনও থিয়েটারে কাজ করছেন। শুধু অভিনয় নয়,বেশ কিছু মঞ্চনাটক হয়েছ তার নির্দেশনায়। উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে ‘নাম জীবন’, ‘ফেরা’, ‘টিকটিকি’, ‘আত্মকথা’,  ‘হোমাপাখি’ প্রভৃতি।
থিয়েটার নিয়ে নিরন্তর আশাবাদি এই শিল্পী বলেন, ‘…থিয়েটার আছে এবং থাকবে, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ আমরা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেই এখনো থিয়েটার করে থাকি। এই ত্যাগ কখনো বৃথা যেতে পারে না। অতীতে যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম একদল ত্যাগি আর নিবেদিত শিল্পী থিয়েটারকে বাঁচিয়ে রাখবে বলে বিশ্বাস করি। হয়তো এটা কখনোই পারফর্মিং আর্টের প্রধান মাধ্যম হবে না, তবে নাট্যকর্মীদের প্রাণশক্তিতেই থিয়েটার টিকে থাকবে।’

অভিনেতা হিসেবে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের খ্যাতির পরও কবি সৌমিত্র যথেষ্ট জনপ্রিয়। ‘ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা’ ‘জলপ্রপাতের ধারে দাঁড়াবো বলে’ ‘শব্দরা আমার বাগানে’ ‘যা বাকি রইল’ ‘পড়ে আছে চন্দনের চিতা’ ‘ধারাবাহিক তোমার জলে’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের কবি নিজের কবিতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘…কবিতা লেখা শুরু নিজের মনের অব্যক্ত বাসনা প্রকাশ করতে না পারার যন্ত্রণা থেকে। কিশোর বয়সে নিজের অব্যক্ত প্রেমাকাঙ্খা প্রকাশের তাড়না থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করি। পরবর্তীতে আমার কবিতায় ধীরে ধীরে উঠে আসে প্রকৃতি, সমাজ, দর্শন, উপলব্ধি। তাছাড়া পড়াশোনাটাও আমি করেছি বাংলা সাহিত্য নিয়ে। যার কারণে কবিতা আমাকে ছাড়েনি। এখনও কবিতা লিখি, যতোদিন মস্তিষ্ক সচল থাকবে কবিতা লিখেই যাবো।’

আঁকাআঁকিতে তার হাত বেশ পাকা। গত পাঁচ দশক ধরে তিনি এঁকে চলেছেন ছবি। তাঁর আঁকা স্কেচ এবং পেইন্টিং নিয়ে প্রদর্শনী হয়েছে ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্সে’। ছবি আঁকার এই ঝোঁক প্রসঙ্গে সৌমিত্র বলেন, ‘…ছোটবেলায় অনেক ছবি এঁকেছি। ফাইন আর্টসে পড়াশোনাও করেছি দুবছর। পরে কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর সেভাবে ছবি আঁকা হয়ে উঠেনি। তবে হাতের কাছে কোনো কাগজ পেলে নকশা আর আলপনা আঁকার একটা অভ্যাস সবসময়ই ছিল। কয়েক বছর আগে মনে হলো, আঁকাআঁকির প্রতি সুবিচার করা হচ্ছে না। ফের রঙতুলি হাতে তুলে নিলাম। খেয়ালি ভাবনা, সৌখিন কাজ। নিজের তৃপ্তির জন্যই ব্যাকরণহীন এইসব আঁকাআকি’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *