কিংকর অধিকারী: আজও ভারতবর্ষের মানুষের কাছে তাদের অন্তরের গভীর শ্রদ্ধার পাত্র নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ‘সুভাষ’ থেকে ‘নেতাজী’ হয়ে ওঠার সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস রয়েছে তাঁর জীবনে। এ কেবল প্রতিভার জোরে হয়নি। এ বিষয়ে তাঁর নিজের কথা–“তোমরা মনে কর যে মহাপুরুষরা বড় হইয়াই জন্মায় – তাঁহাদিগকে চেষ্টা করিয়া, পরিশ্রম করিয়া বা সাধনা করিয়া বড় হইতে হয় না। — কিন্তু এ ধারনা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত।” তিনি নিজে বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছিলেন। যখনই যেখানে অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার দেখেছেন সেখানেই একা হলেও নির্ভিক হৃদয়ে উন্নত শিরে প্রতিবাদ করেছেন এবং তা নিবারণের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছিলেন, “স্কুলে কলেজে ঘরে বাইরে পথে ঘাটে মাঠে যেখানে অত্যাচার অবিচার বা অনাচার দেখিবে সেখানে বীরের মত অগ্রসর হইয়া বাধা দাও–মুহূর্তের মধ্যে বীরত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত হইবে — চিরকালের জন্য জীবনের স্রোত সত্যের দিকে ফিরিয়া যাইবে–সমস্ত জীবনটাই রূপান্তরিত হইবে। আমি আমার ক্ষুদ্র জীবনে শক্তি কিছু যদি সংগ্রহ করিয়া থাকি তাহা শুধু এই উপায়েই করিয়াছি।” এভাবেই তিনি একটু একটু করে এগিয়েছেন এবং এটাই ছিল সুভাষ থেকে নেতাজীতে উত্তোরণের সুদীর্ঘ ইতিহাস। অবশ্য এর জন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি।
১৯০৮ সাল। ফাঁসীর দড়ি গলায় পরে অগ্নিশিশু ক্ষুদিরাম হাসতে হাসতে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে পরিহাস করে নিজের জীবন দিয়ে প্রমান করে গেলেন জীবনের থেকে দেশ বড়। তার ঠিক তিন বছর পরে ১৯১১ সালে কটকে রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র সুভাষ ১১ ই আগষ্ট ক্ষুদিরামের শহীদ দিবস পালন করলেন। ছাত্রাবাসের সকলকে নিয়ে অরন্ধনের মধ্য দিয়ে গভীর শ্রদ্ধায় দিনটি উদযাপন করলেন সুভাষ। সমর্থনে এগিয়ে এসেছিলেন সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বেণীমাধব দাস। এই শিক্ষককে সুভাষ সারা জীবন ভোলেন নি। ছাত্রজীবনে এভাবেই রাজনীতির ছোঁয়া লাগে জীবনে। পড়াশোনার সাথে সাথে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শোষণের যাঁতাকল থেকে দেশের মানুষের মুক্তির চিন্তা তাঁকে উদ্বেল করে তোলে।
কলেজ জীবনে এই মেধাবী ছাত্র যখন প্রেসিডেন্সী কলেজের ছাত্র তখন ওটেন সাহেব ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে অসম্মানজনক মন্তব্য করায় সকল ছাত্রকে নিয়ে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজের ভবিষ্যত জীবনের কথা একটুও ভাবেন নি। এর জন্য ইংরেজ সরকার তাঁকে কলেজ থেকে বিতাড়িত করল। তাতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। যদিও এই দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। স্কটিশচার্চ কলেজে পড়ার ব্যবস্থা তিনিই করে দিলেন।
পরবর্তী ক্ষেত্রে সর্বভারতীয় পরীক্ষা আই সি এসে চতুর্থ স্থান অধিকার করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষ। পরিবার আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই যখন উৎফুল্ল সুভাষ তখন দেশমাতৃকার ভবিষ্যত নিয়ে গভীর চিন্তামগ্ন। একদিকে বাড়ি, গাড়ি,ব্যাঙ্ক-ব্যালেন্স, প্রচলিত চিন্তায় সুন্দর নিরুপদ্রব জীবন আর অন্যদিকে অসহায় মানুষের মুক্তির জন্য নিরলস সংগ্রাম। সমস্ত প্রলোভন ছেড়ে মানুষের মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন বলেই প্রথম নয়, আইসিএসে চতুর্থ স্থানাধিকারী সুভাষচন্দ্রকেই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে মনে রেখেছে মানুষ।
তাঁর জীবনের উপলব্ধি থেকেই তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রচলিত ধারনা “ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ” এর বিরোধিতা করে বলেছিলেন- “অধ্যয়ন কোন দিন তপস্যা হইতে পারে না। অধ্যয়নের অর্থ কতকগুলি গ্রন্থ পাঠ ও কতকগুলি পরীক্ষা পাশ। শুধু ইহার দ্বারা মানুষ স্বর্ণ পদক লাভ করিতে পারে- হয়ত বড় চাকুরী পাইতে পারে- কিন্তু মনুষ্যত্ব অর্জন করিতে পারে না।” আজ নেতাজীর এই চিন্তা ক’জন গ্রহন করতে পেরেছে?
ছাত্র-যুবকদের উদ্দেশ্যে তাঁর করুণ আর্তি-“ছাত্ররাই দেশের আশা। বিশ্বের সর্বত্র তাহারাই স্বাধীনতার অগ্রদূত। তাহাদের লক্ষ্য দেশকে স্বাধীন করা ও নতুন জাতি গঠন করা। ইহা সহজ কাজ নহে। ইহার জন্য দরকার বহু ভাবনা চিন্তা, প্রস্তুতি ও আত্মত্যাগ। দেশের তরুণদের ইহা করিতে হইবে। নিজের আদর্শ স্থির ভাবে অনুসরণ করিয়া যাওয়ার মধ্যে কোন বেদনা নাই। একজন দর্শকের নিকট যা নেহাতই দুঃখকর বলিয়া মনে হয়, একজন উচ্চ আদর্শের অনুসারীর নিকট উহাই আনন্দ স্বরূপ।” বলেছিলেন, “আমরাই দেশে দেশে মুক্তির ইতিহাস রচনা করিয়া থাকি। আমরা শান্তির জল ছিটাইতে এখানে আসি নাই। বিবাদ সৃষ্টি করিতে, সংগ্রামের সংবাদ দিতে, প্রলয়ের সূচনা করিতে আমরা আসিয়া থাকি। যেখানে বন্ধন, যেখানে গোঁড়ামি, যেখানে কুসংস্কার, যেখানে সংকীর্ণতা–সেখানেই আমরা কুঠার হস্তে উপস্থিত হই। আমাদের একমাত্র ব্যবসায় মুক্তির পথ চিরকাল কন্টকশূণ্য রাখা, যেন সে পথ দিয়া মুক্তির সেনা অবলীলাক্রমে গমনাগমন করিতে পারে।”
মানুষের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সহানুভূতি না থাকলে নেতাজী এ যায়গায় আসতে পারতেন না। কলকাতায় নেতাজীর বাড়ির সামনে বসে এক জবুথবু বৃদ্ধা ভিখারী মহিলা প্রতিদিন ভিক্ষা করত। নেতাজীর ভাষায় “যখনই তাকে দেখতাম বা এমনকি তার কথা চিন্তা করতাম, তার করুণ মুখখানি আর তার ছিন্ন বস্ত্র আমাকে যন্ত্রণা দিত। পাশাপাশি, নিজেকে এত স্বচ্ছল ও সুখী মনে হত যে অপরাধী বোধ করতাম। আমার মনে হত-তিনতলা বাড়িতে বাস করার মত এরূপ ভাগ্য করার কি অধিকার ছিল আমার, যখন এই নিঃস্ব ভিখারী মহিলাটির মাথার উপরে কোন আচ্ছাদন এবং প্রকৃতপক্ষে কোন খাদ্য বা বস্ত্র জুটত না? পৃথিবীতে এত দুঃখ যদি থেকে যায় তাহলে যোগের কি মূল্য? এ রকম চিন্তা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমাকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল।”
ভাল ছাত্র হওয়ার কারনে বাবা-মায়ের উচ্চাকাঙ্ক্ষা তৈরী হয়েছিল তাঁকে নিয়ে। মায়ের কাছে তিনি সরাসরি প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনার মতে আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? প্রচুর ধনশালী, গাড়ী, ঘোড়া, মোটর প্রভৃতির অধিকারী, নানা দাস-দাসী প্রভু, প্রকাণ্ড অট্টালিকা ও বিপুল জমিদারির অধিকারী হলে আপনার সবচেয়ে বেশী আনন্দ হবে—না দরিদ্র হলেও….’প্রকৃত মানুষ’ বলে পূজিত হলে বেশী আনন্দ হবে?” পিতামাতার চাহিদাকেই জীবনে যদি তিনি শুধু মূল্য দিতেন তাহলে আজ শতাব্দীকাল পরে কেউ কি তাঁকে স্মরণ করতেন? প্রতি বছর তো কত আই সি এস বেরোচ্ছে, তাদের স্মরণ তো দূরের কথা কেউ নামটুকুও জানে না।
পরবর্তী কালে আর পিছনের দিকে তাকান নি তিনি। দেশের মুক্তি সংগ্রামে পরবর্তী জীবনের সবটুকুই নিঃশেষ করে দিয়েছিলেন। এই অধ্যায়ে তিনি বিবেকানন্দের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে কিছুদিনের জন্য সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহন করেছিলেন। কিন্তু তিনি অভিজ্ঞতার দ্বারা বুঝেছিলেন যে, “বর্তমান যুগে আত্মরক্ষার জন্য এবং জাতির উদ্ধারের জন্য যে শর্ত আমরা চাই তা বনে জঙ্গলে বা নিভৃত কন্দরে তপস্যা করলে পাব না, পাব নিষ্কাম কর্মযোগ দিয়ে, সংগ্রামের ভিতর দিয়ে।” বলেছিলেন, “কর্মবিহীন, বিজন সাধনায় কখনও চরিত্র গঠন হয় না।”
আমরা সকলেই জানি যে, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলন দুইটি ধারায় গড়ে উঠেছিল। একটা আপোষের মধ্য দিয়ে আর একটা আপোষহীন ভাবে লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। প্রথম ধারাটির মূর্ত প্রতীক ছিলেন গান্ধীজী, আর দ্বিতীয় ধারাটির ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। স্বাধীনতা বা মানুষের মুক্তির প্রশ্নে স্বাভাবিক ভাবে গান্ধীজীর সঙ্গে নেতাজীর আদর্শগত দ্বন্দ্ব আমরা দেখতে পাই তৎকালীন রাজনীতিতে। এই দ্বন্দ্বের পরিণতিতেই ত্রিপুরি কংগ্রেসে নির্বাচিত হওয়ার পরেও সুভাষচন্দ্রকে বাধ্য করা হয় সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে। এরপর তাঁর জীবনে শুরু হয় নতুন মোড় এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন সময়ে কোনো দল বা সংগঠন তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান নি। এই সময় তিনি ‘ফর্ডওয়ার্ক ব্লক’ দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবকিছু ছেড়ে বাধ্য হয়ে বিদেশ পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। মনে রাখতে হবে এই সময় চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। একদিকে রয়েছে ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া অন্যদিকে জার্মান, জাপান, ইতালী। স্বাভাবিক ভাবে ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে যেসব শক্তি রয়েছে সেইসব দেশগুলির কাছ থেকে সাহায্যের জন্য তিনি ইংরেজদের চোখে ধূলি দিয়ে পৌঁছে যান জার্মানে। সেখানে হিটলারের সঙ্গে দেখা করে তাঁর বিভৎস চেহারা দেখে সেখান থেকে চলে যান রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক স্ট্যালিনের কাছে। সেখানে স্ট্যালিনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝতে পারেন ভারতবর্ষে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অভিযানে তাঁর বাস্তব অসুবিধার কথা। এরপর তিনি জীবনের কঠিন ঝুঁকি নিয়ে সাবমেরিনে করে পৌঁছান জাপানে। জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তোজোর সংগে স্বাক্ষাত করে জাপানের সহযোগিতায় দিল্লী অভিযানের ডাক দেন। নেতাজীর শর্ত এই অভিযানে তাঁর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সৈনিকরা সামনের সারিতে থাকবেন। কারন স্বাধীনতার জন্য আসল লড়াইটা ভারতীয়দের। তাই রক্ত ঝরিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা আদায় করার জন্য সবার আগে রইল আজাদ হিন্দ বাহিনী। বহু লড়াই ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যখন নেতাজীর বাহিনী ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে ঠিক সেই সময় ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ ই আগষ্ট জাপানের হিরোসিমা এবং নাগাসাকির উপর পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করল আমেরিকা। জাপান আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হল। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্যরা বীর বিক্রমের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয় আজাদি সৈন্যদের। শুরু হয় প্রবল অত্যাচার। বন্দি করা হয় বহু সৈন্যকে। চলে বিচারের নামে প্রহসন। অত্যাচারের মধ্য দিয়েও ইংরেজ বুঝতে পারে এদেশে তাদের শেষ দিন ঘনিয়ে এসেছে।
অনেকের কাছে অপ্রিয় হলেও সত্য এই মহান মানুষটির পাশে সেদিন কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন কেউই দাঁড়ায় নি। বরং প্রতি পদে তাঁকে অসম্মনিত করে আক্রমনও করা হয়েছে। তৎকালীন সময়ে গান্ধীপন্থীরাও যেমন তাঁকে আক্রমন করেছেন তেমনি কমিউনিস্ট দল এবং মৌলবাদী সংগঠন গুলোও তাঁকে আক্রমন করেছেন। কখনো ‘জাপানের দালাল’, ‘তোজোর কুকুর’, কখনও বা ‘বুলেটের মালা’, ‘খোলা তলোয়ার দিয়ে অভ্যর্থনা’ জনানোর মতো অশালীন মন্তব্যও করা হয়েছে তাঁকে নিয়ে।
কোনো সম্প্রদায় বা ধর্মের ভিত্তিতে নয়, সামগ্রিক মানব সমাজের মুক্তিই ছিল তাঁর সংগ্রামের মূল অভিমুখ। তাই তিনি ছিলেন চরমভাবে যেকোনো সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে গান্ধীজী যখন রাজনৈতিক আন্দোলনে সর্ব্বধর্ম সভার মাধ্যমে সকল ধর্মের মানুষকে একত্রিত করতে চেয়েছিলেন তখন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। এমনকি স্বাধীনতা আন্দোলনে যখন এক মন্দির কর্তৃপক্ষ সুভাষচন্দ্রকে অর্থ সাহায্যের জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং শর্ত দিয়েছিলেন হিন্দু ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের মানুষ যেন এই দান গ্রহনের জন্য মন্দিরে না আসে। তখন সুভাষচন্দ্র সেই দান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। হিন্দু বা মুসলমান কোনো মৌলবাদী চিন্তাকে তিনি প্রশ্রয় দেন নি। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গীত কি হবে এই প্রশ্নে একজন সমস্ত ধর্মের কথা দিয়ে একটি সঙ্গীত রচনা করে নেতাজী হাতে তুলে দিয়েছিলেন। নেতাজী সেটি পড়ে তৎক্ষণাৎ প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেই সঙ্গীত রচনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, “কদম কদম বঢ়ায়ে যা…।” মানুষের মুক্তির প্রয়োজনে ধর্মের কোনো ঠাঁই নাই। এভাবেই নেতাজীর মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার দিকটি।রাজনৈতিক আন্দোলনে কোনো ধর্মীয় চিন্তার প্রশ্রয় তিনি কোনোদিনই দেননি।
এ প্রসঙ্গে ১৯২৮ সালে কুষ্টিয়ায় এক জনসমাবেশে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর বিখ্যাত সেই ভাষণের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের স্বার্থ পরস্পরের পরিপন্থী একথা যাঁহারা বলেন তাঁহারা খাঁটি কথা বলেন না। ভারতবর্ষের মূল সমস্যাগুলি কী? খাদ্যভাব, বেকারী, জাতীয় শিল্পের অবক্ষয়, মৃত্যুহার বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যহীনতা, শিক্ষার অভাব–এগুলিই মূল সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান না হওয়ায় জীবন অসহনীয় হইয়া উঠিয়াছে, বাঁচিয়া থাকাও অর্থহীন হইয়া দাঁড়াইয়াছে। আর এই সকল বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমানদের স্বার্থ অভিন্ন।” বলেছিলেন, “হিন্দুরা ভারতে সংখ্যা গরিষ্ঠ বলিয়া ‘হিন্দুরাজের’ ধ্বনি শোনা যায়। এগুলি সর্বৈব অলস চিন্তা। শ্রমসিক্ত জাসাধারণ যে সব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সম্মুখীন, সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলি তাহার কোনোটির সমাধান করিতে পারিবে কি? কিভাবে বেকারত্ব, নিরক্ষরতা, দারিদ্র প্রভৃতি সমস্যার সমাধান হইবে সে সম্বন্ধে তাহারা কোনো পথ নির্দেশ করিয়াছে কি?”(-১৯৩৮ সালে ১৪ই জুন কুমিল্লায় ভাষণ)
শুধু একটা জন্মজয়ন্তী বা মাল্যদান করে নয়, আজও সমাজে আমরা যদি এই মহান মানুষটির জীবন ও সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়ে আরো এগিয়ে যেতে না পারি তাহলে বিরাট এক দুর্দিনের দিকে এগোতে থাকবো আমরা।