কিংকর অধিকারী: এ বছরের আগামী ২৬ শে সেপ্টেম্বর ঘটা করে পালিত হবে ভারতীয় নবজাগরণের পুরোধা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের দ্বিশততম জন্মদিন। আমরা অনেকেই বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে গ্রামে, গঞ্জে, মফস্বলে অনুষ্ঠান মঞ্চে বক্তৃতা করবো আর ছাত্র-ছাত্রীসহ গুণীজনেরা হাততালি দেবেন, বাহবা দেবেন বিদ্যাসাগরের জীবনের বিভিন্ন দিক গুলি জানতে পেরে। কোথাও কোথাও বিশাল মঞ্চ তৈরি হবে, নামিদামি ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হবেন, বিদ্যাসাগর মহাশয়কে প্রণাম জানাবেন।
কিন্তু যে রাজ্যটি তার জন্মভূমি এবং যে বিদ্যালয়টি তাঁর হাতে গড়া সেখানেই তাঁর মর্মর মূর্তি চুরমার হয়ে গেল দুষ্কৃতীদের লাঠি ও পাথরের ঘায়ে। দেশের মানুষ যখন ঘটনাটি জানতে পারল তখন ছি: ছি: পড়ে গেল সর্বত্র। এও কি সম্ভব? নিশ্চয়ই সম্ভব। যা শুরু হয়েছিল অন্যান্য মনীষীদের পাথরের মূর্তির উপর আক্রমণের মধ্য দিয়ে তখন আশঙ্কা তো ছিলই। ভারতবর্ষের যে চরিত্রটি একটি বিরল চরিত্র, গোটা দেশ এক কথায় যাঁর কাছে মাথা নত করে সেই মানুষটির গায়ে যখন হাত পড়ে তখন নতুন করে অন্য কোন মনীষীর গায়ে হাত পড়লে আর বিস্ময়ের কি থাকতে পারে?
দু’দলের সংঘর্ষের মধ্যে বিদ্যাসাগর মশাই আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ালেন কেন? ঘটনার পর জনতাকে বিভ্রান্ত করে স্বাভাবিকভাবেই দু’পক্ষের দোষারোপের চাপানউতোর শুরু হয়েছে। এ দল বলছে বি দল করেছে আর বি দল বলছে এ দল করেছে। যেন মনে হবে দুটো দলের কেউ করেনি। আকাশ থেকে চক্রান্ত করে কেউ এসব করেছে। দুই দলের কাছে অনুরোধ, যারাই এ কাজ করুক না কেন তারা মানুষ নয়, দুষ্কৃতী। তারা মানব সমাজের কলঙ্ক। সাহস পেল কি করে তারা? কোনো দল যদি তাদের এই ক্রিয়াকলাপে অনুমোদন না দিয়ে থাকে তাহলে এই ঘটনার প্রতিবাদে বিরাট একটা ধিক্কার মিছিলের ডাক দিয়ে দুই দলের পক্ষ থেকে কেন আহ্বান জানানো হচ্ছে না? কোন বিশেষ বা দু’চারজনের ভুল সমাজের বিরাট ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু যখন একটা সংগঠিত শক্তি এ কাজ করার ক্ষেত্রে মদত দেয় তখন তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হয়।
ঘটনার পরবর্তীতেই হোয়াটসঅ্যাপ ফেসবুকে বহু ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেখান থেকে কেন নির্দিষ্টভাবে ধরা যাচ্ছে না দুষ্কৃতীদের? কেন সেই দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না? নাকি সময়ের সাথে সাথে আর পাঁচটা ঘটনার মতো এরকম একটি সিরিয়াস ঘটনাও চাপা পড়ে যাবে? এ তো কেবল মাত্র একটি পাথরের মূর্তি নয়। প্রয়োজনে কালকেই তা মেরামত করে নেওয়া যায়। কিন্তু মধ্যযুগীয় বর্বর চিন্তার পরিবর্তে আধুনিক সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নত চিন্তার উপর এ এক বিরাট আঘাত। এ ক্ষত মেরামত করা এত সহজ নয়।
বিদ্যাসাগর যে কেবল ‘বর্ণ পরিচয়’ নয়, দয়ারসাগর নয়, বিদ্যাসাগর হলেন মধ্যযুগীয় সমস্ত প্রকার গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে মুক্ত এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তৎকালীন সমাজ ও সংস্কার থেকে স্রোতের বিপরীতে চলা এক বলিষ্ঠ চরিত্র যা আজও তার জন্মের ২০০ বছর পরে বিস্ময়কর বলে মনে হয়। আসলে বিদ্যাসাগরের মতো মনীষীদের চর্চা আমাদের দেশে ভালো করে হয়নি। তাই তার ফল তো পেতেই হবে। বেশিরভাগ মানুষ বিদ্যাসাগরকে কেবল দয়ারসাগর হিসেবেই চেনে। অথচ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বলেছেন, “দয়া নহে, বিদ্যা নহে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের প্রধান গৌরব তাঁহার অজেয় পৌরুষ, তাঁহার অক্ষয় মনুষ্যত্ব।” বিদ্যাসাগর ভগবান মানতেন না জেনেও বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “আমার জীবনে দু’জন বড় মানুষ, একজন বিদ্যাসাগর, আর অপরজন রামকৃষ্ণ।” বিপরীত মেরুতে থাকা ধর্মীয় জগতে খ্যাত রামকৃষ্ণ কি গভীর আবেগ নিয়ে বিদ্যাসাগরের বাড়িতে গিয়েছিলেন শ্রদ্ধা জানাতে সেকথাও অনেকে জানেন।
তিনি নিজে সংস্কৃত সাহিত্যের দিকপাল হয়েও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী বিজ্ঞান শিক্ষার বিস্তার চেয়ে ছিলেন। তিনি এদেশের বেদান্ত দর্শন নির্ভর শিক্ষার বিরোধী ছিলেন। বলেছিলেন, “কতকগুলি কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয়। কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত দর্শন সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই।” পরিবর্তে তিনি আধুনিক যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তার বিস্তার চেয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় কূপমণ্ডুক চিন্তা থেকে সমাজকে মুক্ত করার লক্ষ্যে নারী শিক্ষার বিস্তার তাঁর হাত দিয়েই হয়েছিল। হিন্দু ধর্মের প্রচলিত চিন্তার বিরুদ্ধে গিয়ে তৎকালীন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে নারীদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের মতো অসাধ্য কাজ তিনিই করেছিলেন। আজ জন্মের ২০০ বছর পরেও তাঁর সেই চিন্তার ধারে পাশে যেতে পারেনি ভারতবর্ষের তামাম অংশের মানুষ। বিদ্যাসাগর পরবর্তী সময়ে তার জীবন ও সংগ্রাম নিয়ে তেমন করে চর্চা করাই হয়নি। পরাধীন ভারতবর্ষ থেকে আজ পর্যন্ত শাসকরা বারবার ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে তাঁর জীবন ও সংগ্রামকে। ভুলিয়ে দিতে না পারলে ওদেরই যে বিপদ! তাইতো বিদ্যাসাগরের পাথরের মূর্তিও আজ ওদের কাছে ভয়ঙ্কর!
হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর মশাইদের মারতেই হবে। ওঁরা মরে গিয়েও মরেনি। তাই তো বারবার মেরে শেষ মৃত্যু পর্যন্ত ওঁদের মারতেই হবে। ওরা কিন্তু সফল হতে চলেছে। আমরা কেবল ঠাণ্ডা ঘরে বসে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় আঙ্গুল ঘষে ওদের দেখানো পথেই পরস্পরকে দোষারোপ করে চলেছি। চাপান উতোরে জড়িয়ে পড়ছি আমরাও। ঘটনার প্রতিবাদে তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ছি কই? সাহস তো ওদের বাড়বেই। বিদ্যাসাগর মশাইরা আজ বড় অসহায়। তাঁরা একসময় সমাজ ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়েছিলেন, আমরা কিন্তু এঁদের বাঁচিয়ে রাখতে পারছি না। তাহলে কি ভারতীয় নবজাগরণ আজ মিথ্যায় পর্যবসিত হবে?
যেমন করে ষাট/সত্তর দশকে কিছু উগ্র বাম মনোভাবাপন্ন মানুষ শ্যামাপ্রসাদ সহ বেশ কয়েকজনের মূর্তি ভাঙার উন্মত্ত প্রয়াসে মেতে উঠেছিল। আজও সারা ভারতবর্ষ জুড়ে চলছে সেই একই ধরনের খেলা। ত্রিপুরায় লেনিন, সুকান্ত। তামিলনাড়ুতে পেরিয়ার, উত্তরপ্রদেশে আম্বেদকার, ব্যারাকপুরে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, আসামে রবীন্দ্রনাথ আর আজ বাংলায় বিদ্যাসাগর। এছাড়া নেতাজিসহ বহু বড় মানুষের মূর্তিতে কালি লেপনের ঘটনা চলছে অহরহ।
কোন ব্যক্তির চিন্তা নিয়ে মতদ্বৈততা থাকতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রে তা থাকাই স্বাভাবিক। মনীষীদের ক্ষেত্রেও তাই। বিপরীত চিন্তা হলেই কি আক্রমণ করতে হবে? কেউ শ্যামাপ্রসাদকে আদর্শ মনে করতে পারেন কেউ বা লেনিনকে, আবার কেউবা গান্ধীজিকে। এ নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে। নীতি বা আদর্শের দ্বন্দ্ব তো থাকতেই। এভাবেই তো সমাজ এগিয়েছে। তা না করে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আক্রোশ অথবা মূর্তি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে কদর্যভাবে আক্রমণ কোন্ সুসভ্য সংস্কৃতির জন্ম দেবে? এ কি সুস্থ সংস্কৃতি? বন্যজীবন কি আমাদের ঠিকানা হতে চলেছে? চারিদিকে এতো এতো আলো, তবু যেন ঘনিয়ে আসছে জমাট বাঁধা কালো!
বিদ্যাসাগর মশাই শেষ জীবনে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “এ দেশের উদ্ধার হইতে বহু বিলম্ব আছে। পুরাতন প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি বিশিষ্ট মানুষের চাষ উঠাইয়া দিয়া সাত পুরু মাটি তুলিয়া ফেলিয়া নতুন মানুষের চাষ করিতে পারিলে, তবে এদেশের ভালো হয়।” আজ হাড়ে হাড়ে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি আমরা সে কথা। বিদ্যাসাগরের জন্মের ২০০ বছর পূর্তিতে এ ঘটনা আমাদের সবাইকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আমরা পারব কি তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দিতে?