কলকাতা: রাজ্যের বিভিন্ন খবরের চ্যানেলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা ক্লাস নিচ্ছেন। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে একটি নির্দিষ্ট দু’টি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। কারণ, করোনা সংক্রমণ থেকে ছাত্রছাত্রীদের বাঁচাতে রাজ্য সরকার স্কুলগুলি বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে৷ কিন্তু, এই দীর্ঘ বিরতির মধ্যে ছাত্রদের পড়াশুনায় এবং মনসংযোগে ক্ষতি করতে পারে ভেবে টিভি-চ্যানেলের মাধ্যমে ক্লাসরুম চালানোর ব্যবস্থা নিয়েছে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যের শিক্ষা দফতর। শুরুতেই তা অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু, মুদ্রার একটি অন্য পিঠও রয়েছে।
অভিযোগ, কিছু বিদ্যালয়, মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক কিংবা টিচার-ইন-চার্জ'রা স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিশেষ হোয়াটস আপ (What's App) গ্রুপ তৈরি করে 'বাধ্যতামূলক' অনলাইন ক্লাস নেওয়ার নির্দেশ জারি করেছেন। অথচ, এই বিষয়ে রাজ্যের শিক্ষা দফতরের তেমন কোনও নির্দেশ নেই। অভিযোগ, ওই বিদ্যালয় প্রধানরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ক্লাস নিতে বাধ্য করছেন। ভয় দেখিয়ে মানসিক চাপ তৈরির চেষ্টার অভিযোগও রয়েছে।
রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষা দফতরের পোর্টালে 'Model Activity Task' সংক্রান্ত সাধারণ নির্দেশিকায় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট করেই বলা রয়েছে, “বিদ্যালয় খুললে এক্টিভিটি টাস্কগুলি শিক্ষকদের কাছে জমা দিতে হবে (৩ নম্বর পয়েন্ট)। প্রয়োজনে বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সহায়তা নিতে পারো (৪ নম্বর পয়েন্ট)। প্রয়োজনে বিদ্যালয় শিক্ষক মডেল এক্টিভিটি টাস্ক পরিবর্তন করে ফোন, এস এম এস ইত্যাদির মাধ্যমে নিজ স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠাতে পারেন (৫ নম্বর পয়েন্ট)।” অভিযোগ, কিছু বিদ্যালয় প্রধান নির্দেশিকায় 'প্রয়োজনে' শব্দটি গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। উল্টো তাঁরা নিজেই এই সুযোগে এক বা একাধিক হোয়াটস আপ গ্রুপ তৈরি করেছেন। কিছু ক্ষেত্রে স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকদের অনুমতি না নিয়েই তাদের ফোন নম্বর ওই গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিছু, স্কুলের প্রধানরা আবার ইতিমধ্যেই একটি অস্থায়ী 'ক্লাস রুটিন' তৈরি করে শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস নিতে জোরাজুরি করছেন।
প্রশ্ন উঠেছে, সকল শিক্ষক-শিক্ষকার পারিবারিক পরিস্থিতি একই রকম নয়। সকলের বাড়িতেই অনলাইন ক্লাস নেওয়ার উপযোগী পরিস্থিতি থাকবে তা বিদ্যালয় প্রধানরা কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন। সব থেকে বড় প্রশ্ন, অনলাইন ক্লাস নেওয়ার উপযোগী ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তা অনেক মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক-মাদ্রাসা'র শিক্ষক শিক্ষিকাদের বাড়িতে প্রযুক্তি নাও থাকতে পারে। লকডাউনের বাজারে এই বাড়িতে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার উপযোগী ব্যবস্থা রাতারাতি জোগাড় করা অসম্ভব। গ্রামে পরিস্থিতি আরও দুষ্কর। অভিযোগ অনুসারে, কিছু বিদ্যালয় প্রধান বলছেন, হোয়াটস আপে অনলাইন ক্লাস নিতে হবে। যা অতি অমূলক যুক্তি। কারণ, হোয়াটস আপের ভিডিও কনফারেনসিং কলে ৪ জনের বেশি একত্রে কথা বলা যায় না।
সেক্ষেত্রে, শিক্ষকদের যুক্তি ক্লাসের মাত্র ৩ জনকে পড়িয়ে কি লাভ হবে। তাছাড়া, মোবাইল পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলির ইন্টারনেট ক্লাস নেওয়ার জন্য উপযোগী নয়। ওই ইন্টারনেটের গতি এতই কম যে আধ ঘণ্টার একটি টিউটোরিয়াল ক্লাসের ভিডিও হোয়াটস আপের মাধ্যমে এক ব্যক্তির থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। সেক্ষেত্রে দ্রতগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থা না থাকলে ক্লাস করা সম্ভব নয়।
হোয়াটস আপের মাধ্যমে অনলাইন ক্লাস করার একটি বার্তা ফেসবুকে বিভিন্ন শিক্ষকদের গ্রুপে দেখা গিয়েছে। সেই বার্তায় বিদ্যালয় প্রধানদের রুটিন তৈরি করতে বলা হয়েছে। শিক্ষকদের ক্লাস ম্যাটেরিয়াল আপলোড (পিডিএফ বা ওয়ার্ড ফরম্যাটে) করতে বলা হয়েছে। ইউটিউব লিংক দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু, কোথায় তা করতে হবে তা স্পষ্ট বলা নেই। প্রশ্ন উঠেছে, শিক্ষকরা যদি কোন ইউটিউব চ্যানেলের লিংক পোস্ট করবেন? রাজ্য সরকারের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলের, নাকি তার ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়া ইউটিউব চ্যানেলের। স্কুলের হোয়াটস আপ গ্রুপে ব্যক্তিগত উদ্দ্যোগে গোড়া ইউটিউব চ্যানেলের লিংক একজন শিক্ষক কী ভাবে পোস্ট করতে পারবেন? তার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনও সরকারি নির্দেশিকা রয়েছে কী?
কলকাতার কমলা বিদ্যমন্দির হাইস্কুল ফর গার্লসের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা সঙ্ঘমিত্রা ভট্টাচার্য বলেন, “শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অসাধারণ উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য শিক্ষা দফতর। কিন্তু, প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকা-টিচার ইন চার্জ'রা ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুলে হোয়াটস আপ গ্রুপ তৈরি করে সরকারি সার্কুলারকে লঙ্ঘন করছেন। ছাত্র ছাত্রীরা সকাল থেকে বিকাল হাতে মোবাইল নিয়ে বসে থাকলে তাদের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। ছাত্ররা এতক্ষন হাতে স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে থাকবে কোন যুক্তিতে? যদি তারা ফোন কোনও খারাপ উদ্দেশে ব্যবহার করে তবে স্কুল কি দায় নেবে। ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মা'রাও কি সর্বক্ষণ তাদের পাশে লক্ষ রাখতে পারবেন। সব থেকে বড় প্রশ্ন, সরকার যে টিভি চ্যানেলে ক্লাস দেখার কথা জানিয়েছে, তা কখন দেখবে ছাত্ররা। সারা দিন ফোন নিয়ে বসে থাকলেই কি চলবে? শিক্ষা মন্ত্রী টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যে ক্লাস নেওয়ার কথা বলেছে, তার উপর প্রধান শিক্ষকদের কী ভরসা নেই? হোয়াটস আপে অনলাইন ক্লাস নিতে তাঁরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উপর চাপ সৃষ্টি করেছেন কেন?”
নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক শিক্ষিকা জানিয়েছেন, “কোনও কোনও স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা আবার শিক্ষা দফতরের দুই একজন কর্তাকে ওই হোয়াটস আপ গ্রুপে যোগ করে রেখেছেন। শিক্ষিক-শিক্ষিকাদের এই বলে ভয় দেখাচ্ছেন যে, বোর্ড সব দেখছে। ক্লাস না করলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি দিব্যেন্দু মুখার্জি বলেন, “সরকারি নির্দেশনামা নেই। তাই হোয়াটস আপে এই ধরণের ক্লাসের কোনও গুরুত্ব নেই। রাজ্য সরকার টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে ছাত্র ছাত্রীরা উপকৃত হচ্ছে। কোনও প্রধান শিক্ষক হোয়াটস আপে কি করল, তার কোনও গুরুত্ব নেই।”
কালেজিযাম অফ এসিস্টেন্ট হেড মাস্টার এন্ড হেড মিস্ট্রেস-এর সম্পাদক সৌদীপ্ত দাস বলেন, “সম্পুর্ন অনৈতিক। কোনও হেড মাস্টার বা টি এই সি হোয়াটস আপ গ্রুপ করে অনলাইন ক্লাসের কথা বলতে পারেন না। সরকারি নির্দেশে সেরকম কিছুই নেই। ছাত্ররা যদি ফোন নিয়ে বসে থাকে তবে টিভি চ্যানেলের ক্লাস করবে কি করে? বাড়িতেই বা অধ্যায়ন করবে কি করে?”