কিংকর অধিকারী: আশঙ্কা অনেক দিন আগে থেকেই ছিল। আজ তা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে মানুষের কাছে। বহুদিন থেকে শিক্ষা জগতের ব্যক্তিগণ এই আশঙ্কার কথা সরকারের কাছে এবং জনসাধারণের সামনে বারবার তুলে ধরেছিলেন। প্রতিকার চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু যাঁরা পরিচালকের আসনে রয়েছেন তাঁরা বিন্দুমাত্র উদ্বেগ প্রকাশ করেননি এবং প্রতিকারে কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। তাই সরকারি বা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলি আজ ক্রমশ ছাত্র-সংকটের মুখে।
সম্প্রতি জানা গিয়েছে কলকাতাতেই প্রায় ১৩৫ টি প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছাত্রাভাবে প্রায় বন্ধ। সেইসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কোথাও শূন্য, আবার কোথাও সে সংখ্যা ১০, ২০ বা ৫০-এর মধ্যে। এ খবর নতুন নয়, বেশ কয়েক বছর আগে খোদ কলকাতাতেই প্রায় ধীরে ধীরে ২০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল স্রেফ শিক্ষার্থী অভাবের কারণে।
এ তো গেলো কলকাতার কথা। সারা রাজ্যে আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে যদি লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাবো, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির অধিকাংশই চরমভাবে ছাত্র সংকটে ভুগছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এই সঙ্কট পুরোপুরি বেমানান। একইভাবে মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলি ক্রমশ এই তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সামান্য টাকার বিনিময়ে শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগের মাধ্যমে এসএসকে, এমএসকে বিদ্যালয়গুলি চালু করায় দূরত্বের কারণে কিছু শিক্ষার্থী সেখানে থেকে যায়। ফলে পাশাপাশি সরকারি বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা কমেছে। আবার কিছু নতুন উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠায় হাই স্কুলের ছাত্র সংখ্যা কিছুটা কমেছে। কিন্তু সার্বিকভাবে সারা রাজ্যে সরকারি বা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলির ছাত্র সংকটের কারণ ভিন্ন। সেই সংকটের প্রকৃত কারণ কি? প্রতিকারের উপায় বা কি?
বরাবরই অভিভাবকগণ চান তাঁদের সন্তান-সন্ততি উপযুক্ত শিক্ষা পাক। তার জন্য একজন সাধারন রিকশাচালক বা খেটে খাওয়া মানুষও তাঁর রোজগারের বেশিরভাগটাই সন্তানদের শিক্ষার জন্য খরচ করে প্রাণপাত পরিশ্রম করেন। সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় যদি সেই উপযুক্ত শিক্ষা না পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় তাহলে অভিভাবকগণ বাধ্য হন বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির দিকে ঝুঁকতে। চাহিদামত শিক্ষা পেলে কোনো অভিভাবক চাইবেন না সরকারি বিদ্যালয় থেকে তাঁর সন্তানকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে অধিক অর্থের বিনিময়ে বেসরকারি বিদ্যালয় ভর্তি করতে। তাহলে কি শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের চাহিদা মেটাতে ব্যর্থ বর্তমান সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা? সে দায়িত্ব কার?
প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলিতে ছাত্রসঙ্কট আজ নতুন নয়। বিগত দিনে যেদিন প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিষয় শিক্ষা হিসাবে ইংরেজি তুলে দেওয়া হয়েছিল এবং অবাধ প্রমোশনের সরকারি নীতি চালু হয়েছিল সেদিন থেকেই। ১৯৭৭/৭৮ সালে যখন সরকার এই নীতি গ্রহণ করেছিল সেই সময় থেকেই প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যাপকভাবে বেসরকারিকরণ শুরু হয়। একটু অভিজ্ঞতা দিয়ে যাচাই করে দেখুন, শহর বা গ্রামাঞ্চলে যেসব বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল তাদের অধিকাংশের জন্ম তারিখগুলি সেই সময়ে বা তার পরে।
২০০৯ সালের 'রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্ট' অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার সামগ্রিক শিক্ষার পরিকাঠামোর উন্নয়ন না ঘটিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবাধ প্রমোশনের নীতি ঘোষণা করে। এই নীতি সারাদেশে অন্যান্য রাজ্যের ক্ষেত্রে নতুন হলেও আমাদের রাজ্যে নতুন নয়। এ বিষয়ে এ রাজ্যে তিক্ত অভিজ্ঞতা শিক্ষক, অভিভাবক সবার রয়েছে। বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থার তথ্য থেকে প্রমাণিত হয়েছে সামান্যতম মান অর্জন না করেই শিক্ষার্থীরা অবাধে প্রমোশন পাওয়ায় শিক্ষার ভিত্তি আরো নড়বড়ে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকদের বিরাট একটা অংশ তাঁদের সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানদের এইসব বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বেসরকারি বিদ্যালয়ে ভর্তি করছেন।
যে কোন দেশের শিক্ষার ভিত্তি হলো সে দেশের প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষাকে অবহেলা করে কোনোভাবেই সামগ্রিক শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বহীন করে রাখা হয়েছে। সত্তর বা আশির দশকের প্রথমদিকে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি ছাত্র-ছাত্রীতে ভরপুর ছিল। তারপর সরকারি অবহেলায় বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষক নিয়োগ অনিয়মিত হতে থাকে। এমনকি অসংখ্য বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে পঠন-পাঠন চলতে থাকে। চারটি শ্রেণীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণে শ্রেণিকক্ষ ছিল না। শিক্ষার মান দ্রুত নিচের দিকে নামতে থাকে। আজও একই ভাবে এই সংকট চলছে। একটা বেসরকারি বিদ্যালয়ে যে পরিমাণে শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মী বা সামগ্রিক ব্যবস্থা থাকে সরকারি অবহেলায় সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে তা নেই। বহু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণি অনুযায়ী শিক্ষক নেই, একটি বা দুটি শ্রেণিকক্ষ। পঠন পাঠনের পরিবর্তে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে অন্যান্য বিষয়ে। অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলি আজ অসম্ভব ছাত্র সংকটে! নিম্নবিত্ত পরিবারের অভিভাবকরাও আর্থিক সংকট সত্ত্বেও তাঁদের সন্তানকে বেসরকারি নার্সারি স্কুল গুলোতে ভর্তি করছে শিক্ষা গ্রহণের জন্য।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত অবাধ প্রমোশন নীতি চালু হওয়ার ফলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে একইভাবে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হচ্ছে। তার সাথে দীর্ঘদিন ধরে নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ বন্ধ। শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারে চলছে নানা ধরনের কোটকাচারী এবং টালবাহানা। একইভাবে শিক্ষা বহির্ভূত কাজে বিদ্যালয় গুলিকে কাজে লাগানো হচ্ছে। মিড ডে মিল, শিক্ষাশ্রী, কন্যাশ্রী, বিভিন্ন ধরনের গ্র্যান্ড, ছাতা, ব্যাগ, জুতো প্রদান ইত্যাদি কাজে শিক্ষকরা নিয়োজিত। অথচ শিক্ষার মূল জায়গাটিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। পঠন-পাঠনকে গতানুগতিক পদ্ধতির পরিবর্তে ডিজিটাল ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি, প্রজেক্টর সহ ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয় ও অত্যাধুনিক ভাবে গড়ে তুলবার প্রয়োজন ছিল। শিক্ষাক্ষেত্রে নিবিড় নজরদারি ব্যবস্থারও প্রয়োজন ছিল। সে ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই।
অনেকে বলছেন, ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়ের প্রতি অভিভাবকদের আকর্ষন থেকেই সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলি আজ সংকটের মুখে। এ কথাটি সম্পূর্ণ সত্য নয়। সম্প্রতি দিল্লির কেজরিওয়াল সরকার শিক্ষাক্ষেত্রকে যেভাবে ঢেলে সাজিয়েছে সেখান থেকে যদি আমরা তথ্য সংগ্রহ করি তাহলে দেখতে পাবো সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে কিভাবে উন্নত করা হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এক সময় যেসব অভিভাবকগণ বেসরকারি বিদ্যালয়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন আজ তাঁরাই স্রোতের মতো সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে সরকারি বিদ্যালয়ে তাঁদের সন্তানদের ভর্তি করছেন। এটা সম্ভব হয়েছে সরকারিভাবে শিক্ষাকে আন্তরিকভাবে রক্ষা করার তাগিদ থেকে। আমরা সেভাবে ভাবতে পেরেছি কি? যাঁরা ভাবছেন, বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়গুলিকে শুধু ইংরেজি মাধ্যমে কনভার্ট করে দিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তাঁরা সঠিক ভাবছেন না। সামগ্রিকভাবে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা দু'ধরনের অর্থাৎ কোথাও বাংলা মাধ্যম আবার কোথাও ইংরেজি মাধ্যম – তা হতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হবে যেখানে ধনী দরিদ্র সবধরনের ছাত্রছাত্রীরা মাতৃভাষার পাশাপাশি যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে ইংরেজি ভাষাটাও শিখবে। দক্ষিণ ভারতের বহু রাজ্য রয়েছে যেখানে ছাত্রছাত্রীরা তাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ মালায়ালাম, কন্নড় ইত্যাদি ভাষা গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষাতেও যথেষ্ট দক্ষ।
আমাদের রাজ্যে তেমনভাবে সিলেবাস, শিক্ষাদান পদ্ধতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে আধুনিক পদক্ষেপ গ্রহণে কোন সরকারি প্রচেষ্টা চোখে পড়ছে না। পড়বে কি করে? সরকারের উদ্দেশ্য যদি বেসরকারিকরণ হয় তাহলে তারা তো এভাবেই শিক্ষাকে মানুষের কাছে ক্রমশ হাস্যকর করে তুলবে এবং বোঝাতে চাইবে প্রকৃত শিক্ষা বেসরকারি বিদ্যালয় ছাড়া সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয় গুলিকে তুলে দেওয়া হবে। আর শিক্ষার দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে সরকার। এই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে যতই কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করা হোক না কেন শিক্ষার সার্বিক মান উন্নয়ন সম্ভব নয়।
এমন একটা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠুক যেন সেই শিক্ষাব্যবস্থায় নেতা, মন্ত্রী, আমলা, ডাক্তার, শিক্ষক, আইনজীবীসহ সাধারণ মানুষের সন্তানরা একসাথে একই ধরনের বিদ্যালয় থেকে তাদের জ্ঞান আহরণ করবে। বিশেষ ধরনের কোনো বিদ্যালয়ের প্রয়োজন থাকবে না। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করুক সরকার।
এক্ষেত্রে সরকার, প্রশাসন, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের দায়িত্বকে কোনভাবেই অস্বীকার করা চলে না। সরকারের ভূমিকার পাশাপাশি শিক্ষকদের দায়িত্ববোধ বা কর্তব্যবোধের ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি থাকলে নিশ্চয়ই তা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। প্রাথমিক শিক্ষাসহ বিদ্যালয় শিক্ষাকে ঢেলে সাজাবার জন্য সরকারকে বাধ্য করতে শিক্ষক এবং অভিভাবকদের যৌথভাবে ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্য দিয়েই শিক্ষা বাঁচবে। আর শিক্ষা বাঁচলে বিদ্যালয় থাকবে, বিদ্যালয় থাকলে শিক্ষক-শিক্ষিকা শিক্ষাকর্মী থাকবেন। তবেই নিজেদের সন্তান এবং সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীরা যথার্থ শিক্ষা পাবে। আসুন, নিজেদের দায়বদ্ধতাকে অস্বীকার না করে শিক্ষার সার্বিক মানোন্নয়নে সরকারকে বাধ্য করি।
মতামত লেখকের নিজস্ব৷