মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে মূল্যায়নের ঘোষিত পদ্ধতি প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন এবং বাস্তবতা

মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকে মূল্যায়নের ঘোষিত পদ্ধতি প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন এবং বাস্তবতা

কিংকর অধিকারী: মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ঘোষিত পদ্ধতি প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন এবং বাস্তবতা৷

১) এতদিনের নিয়ম অনুযায়ী যেহেতু একাদশ শ্রেণির পাশ নম্বর ছাড়া এই পরীক্ষার ফল কোন কাজে লাগে না তাই সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা সিরিয়াসলি দেয় না। দ্বাদশ শ্রেণিতে গিয়ে তারা গুরুত্ব সহকারে পড়াশোনা করে এবং উচ্চমাধ্যমিকে ভাল ফলাফল করে। এরকম বহু নজির শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে রয়েছে।  ফলে একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে নম্বর দেওয়ার পদ্ধতিতে বহু ছাত্র-ছাত্রীর প্রকৃত মূল্যায়ন হবে না। ক্ষতিগ্রস্থ হবে বিশাল অংশের ছাত্র-ছাত্রী। 

যেমন ধরা যাক কোনো ছাত্র মাধ্যমিকে চারটি বিষয়ের প্রতিটিতে সর্বোচ্চ নম্বর ৮০% অর্থাৎ চারটি বিষয়ে মোট ৩২০ নম্বর পেয়েছে কিন্তু সেই ছাত্র একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা গুরুত্ব সহকারে না দেওয়ার জন্য নন ল্যাব একটি বিষয়ে ৩০ নম্বর পেয়ে পাশ করেছে এবং প্রজেক্টে পেয়েছে ১৮ নম্বর। তাহলে উচ্চমাধ্যমিকের মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী সেই ছাত্রটি ঐ বিষয়ে নম্বর পাবে —
২৮×৩২০÷৪০০=২২.৪(মাধ্যমিকের সর্বোচ্চ চারটি বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে)
৪৮×৩০÷৮০=১৮(একাদশ শ্রেণির প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে)
প্রোজেক্ট –     ১৮
মোট নম্বর = ৫৮.৪

এইভাবে উচ্চমাধ্যমিকের বহু ছাত্র-ছাত্রীর অবমূল্যায়ন হবে। মাধ্যমিকে ৮০% পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রী এক্ষেত্রে উচ্চমাধ্যমিকে ৬০%-এর নিচে নম্বর পাবে।

২)    আবার মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে যেহেতু বিদ্যালয় গুলিকে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার নম্বরের ভিত্তিতে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে সে ক্ষেত্রে বহু ক্ষেত্রেই চাপ সৃষ্টি হবে যথাসম্ভব নম্বর বাড়িয়ে পর্ষদে পাঠানোর জন্য। পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্ন বিদ্যালয়ে বিভিন্ন ভাবে চলার ফলে এখানেও যথাযথ মূল্যায়ন বাধাপ্রাপ্ত হবে। উন্নত মেধা সম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রীরা প্রকৃত মর্যাদা পাবে না। ভালো মন্দ সব একাকার হয়ে যাবে।

৩) ২০১৯ সালের নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার নম্বর বাংলার শিক্ষা পোর্টালে অনেক বিদ্যালয় আপলোড করে দিয়েছিল। আবার অনেক বিদ্যালয় তা করে উঠতে পারিনি। যারা আপলোড করে দিয়েছিল তাদের কি নতুন করে নম্বর পাঠাতে হবে? নাকি তাদের সেই সুযোগ থাকছে না। এই বিষয়টাও পরিষ্কার হওয়া দরকার।

৪)   মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী কোন ছাত্র-ছাত্রী যদি নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় ১ অথবা ২ নম্বর পেয়ে থাকে তাহলে সেও পরীক্ষায় পাশ করবে। কেননা বলা হয়েছে নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার প্রাপ্ত নম্বরের ৫০% যুক্ত হবে দশম শ্রেণির ফরমেটিভ অর্থাৎ বিদ্যালয়ের ইন্টার্নাল নম্বরের ৫০% এর সঙ্গে। অর্থাৎ কেউ যদি ইন্টারনাল নম্বর ১০ নম্বর পায় তাহলে সে ৫০ নম্বর পাবে এবং নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় কোন বিষয়ে সে যদি ২ পায় তাহলে দুটি যুক্ত হয়ে তার ওই বিষয়ে প্রাপ্ত নম্বর হবে ৫০+১=৫১ ।

৫)  যেসব বিদ্যালয় এখনো পর্যন্ত একাদশ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার নম্বর উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের কাছে পাঠায় নি তারা বেশি করে নম্বর পাঠানোর সুযোগ পাবে কিন্তু আগে যারা নম্বর পাঠিয়ে দিয়েছে(বেশিরভাগ ক্ষেত্রে) সেই সব বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সেই সুযোগ না পাওয়ার ফলে নম্বরের পার্থক্য তৈরি হবে। এই বৈষম্য কিভাবে দূর হবে?

৬)     একাদশ শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনটি, কয়েকটি ক্ষেত্রে চারটি বিষয়ের উপর পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল। বাকি পরীক্ষাগুলো তারা দিতে পারেনি। সেই বিষয়গুলির নম্বর দেওয়ার পদ্ধতি হয়ত গত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের মতো করেই সম্পন্ন করা হবে কিন্তু সংসদের গাইডলাইনে তার উল্লেখ নেই।

৭)    সিসি অথবা স্পেশাল ক্যাটাগরির পরীক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মূল্যায়ন কোন পদ্ধতিতে হবে সে ব্যাপারে কোনো দিক নির্দেশ নেই।

৮)  মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুযায়ী এবছর কোনো অকৃতকার্য থাকছে না, সমস্ত পরীক্ষার্থী পাশ অর্থাৎ দুটি পরীক্ষাতেই ১০০% কৃতকার্য হতে চলেছে।

৯) বলা হয়েছে ঘোষিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে কোন ছাত্র বা ছাত্রী খুশি না হলে তারা করোনা পরিস্থিতি কেটে গেলে পরীক্ষা দিতে পারবে কিন্তু কবে সেই পরীক্ষা এবং ফল প্রকাশ হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। এর ফলে সেই শিক্ষার্থীরা কতদিন অপেক্ষা করে বসে থাকবে ভবিষ্যতের জন্য? তারা বাধ্য হবে বর্তমান মূল্যায়ন পদ্ধতি মেনে নিতে।

 ফলে দেখা যাচ্ছে এই পদ্ধতিতে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের যথার্থ মূল্যায়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়। উচ্চ মেধা, মধ্য মেধা, কম মেধা সম্পন্ন শিক্ষার্থীরা একাকার হয়ে যাবে। আর কৃতকার্য হওয়ার পর তৈরি হবে তীব্র ভর্তি সংকট। সমস্ত ছাত্রছাত্রীকে তার পছন্দমতো বিষয়ে ভর্তির সুযোগ করে দিতে পারবে তো সরকার? তা যদি না হয় তাহলে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আসলে প্রতারণা করা হবে যা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়।

আগামী বর্ষের পরীক্ষার্থীদের জন্য এখন থেকে বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার ভিত্তিতে অগ্রসর হতে হবে। বছর বছর এই পদ্ধতি শিক্ষার মানকে হাস্যকর জায়গায় নিয়ে যাবে। শিক্ষিত এবং অশিক্ষিতের মধ্যে ফারাক থাকবে না।
 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

one × three =