পাশ-ফেল ও নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন ব্যবস্থা: শিক্ষার মানোন্নয়ন কোন পথে?

কিংকর অধিকারী: বহু টালবাহানার পর রাজ্য সরকার অন্যান্য শ্রেণির পরিবর্তে কেবল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির জন্য পাশ-ফেল প্রথা চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন হল এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কতটা ঘটবে? প্রথমেই বলি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল যেখানে শিক্ষার্থীদের ফেল করবার প্রশ্নই আসবেনা। তা যদি আমাদের দেশে বা রাজ্যে সর্বতোভাবে কার্যকরী হতো

পাশ-ফেল ও নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন ব্যবস্থা: শিক্ষার মানোন্নয়ন কোন পথে?

কিংকর অধিকারী: বহু টালবাহানার পর রাজ্য সরকার অন্যান্য শ্রেণির পরিবর্তে কেবল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির জন্য পাশ-ফেল প্রথা চালু করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন হল এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কতটা ঘটবে? প্রথমেই বলি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল যেখানে শিক্ষার্থীদের ফেল করবার প্রশ্নই আসবেনা। তা যদি আমাদের দেশে বা রাজ্যে সর্বতোভাবে কার্যকরী হতো তাহলে এ নিয়ে এতো বিতর্ক তৈরি হতো না।

১) যদি গতানুগতিক শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে প্রোজেক্টর সহ উন্নত ক্লাস রুম গঠন এবং আকর্ষণীয় পরিকাঠামো গড়ে তোলা যেতো
২) যদি উন্নত দেশগুলির মতো ছাত্র শিক্ষক অনুপাত ২০:০১ করা যেতো
৩) যদি প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষকসহ সামগ্রিক পরিকাঠামো, প্রাথমিক স্কুলে ক্লার্ক, গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগ করা যেতো
৪) যদি সমস্ত স্তরে পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক-শিক্ষিকা নিয়োগ, শিক্ষা বহির্ভূত কাজ ( যথা ভোটার তালিকায় নাম তোলা, মিড ডে মিল, কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রী, নানা ধরনের স্টাইফেন, ব্যাগ, জুতো, ইত্যাদি কাজে সারা বছর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিরাট অংশকে কাজে লাগিয়ে রাখা) থেকে শিক্ষিক-শিক্ষিকাদের অব্যাহতি দেওয়া যেতো
৫) যদি পাঠদানের উন্নতিকল্পে, শিক্ষাদান পদ্ধতির উন্নতি সাধনে, শিক্ষার সিলেবাস গঠনে শিক্ষকদের মতামত গ্রহণ করা হতো
৬) যদি প্রকৃত অর্থে শিক্ষাব্যবস্থাকে সকলের জন্য সম্পূর্ণভাবে অবৈতনিক করা যেতো,
৭) যদি বিদ্যালয়গুলিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা যেতো
৮) যদি বিদ্যালয়গুলিতে সার্বিকভাবে নিয়মিত নিবিড় নজরদারি ব্যবস্থা থাকতো, ইত্যাদি। এক কথায় আদর্শ শিক্ষার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়কে ভয় করবে না, বরং বিদ্যালয়ের পরিবেশ শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করবে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় এগুলি চালু থাকলে শিক্ষার্থীকে জোর করে পাশ করিয়ে দেওয়ার কোন প্রশ্নই আসতো না। স্বাভাবিক নিয়মেই সে পাশ যোগ্যতার থেকে অনেক উন্নত মান অর্জন করে উত্তীর্ণ হতে পারত। নতুন নিয়মে বিদ্যালয়গুলিতে পাশ নম্বরের মান কমিয়ে আনা হয়েছে ২৫ এ। এখন ফর্মেটিভ ওয়ার্কের নামে ১০ নম্বর পাইয়ে দেওয়ার রীতি চালু হয়ে গিয়েছে। এছাড়া শুধু অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কেন, মাধ্যমিকেও প্রতিটি বিষয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে ১০ নম্বর পাইয়ে দেওয়ার রীতি আছে। বাকী ৯০ নম্বরের মধ্যে কয়েক নম্বর বাদ দিলে বাকি সব এক কথায় বা ঠিক দাগ দিলেই অনেক নম্বর। একই ভাবে উচ্চমাধ্যমিকেও ২০ নম্বর প্রোজেক্ট ওয়ার্ক এবং ভুরি ভুরি মাল্টিপল চয়েস এবং সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি সহজে পাশ নম্বর তোলার জন্য বিশেষ আয়োজন। ছোট প্রশ্নের আধিক্য বাড়ার ফলে হল ম্যানেজ বা গণ টোকাটুকির প্রবনতাও বাড়ছে। ফলে এখন ফেল করাটাই কষ্টের! তেমন কিছু না জানলেও সবাই পাশ করে যাবে। ঘুরিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থায় পাশ-ফেল ব্যবস্থা তো তুলেই দেওয়া হয়েছে!

শিক্ষার গুণগত মান বজায় রেখে সমস্ত শ্রেণিতে নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়ন ব্যবস্থার পাশাপাশি কাঙ্খিত মান অর্জনের জন্য পাশ-ফেল ব্যবস্থাও সমান্তরালভাবে চলুক। কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নভাবে দুটি শ্রেণি(পঞ্চম ও অষ্টম)-র জন্য এই ব্যবস্থা পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলবে।

বলা হয়েছে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে যারা ফেল করবে তাদের দুমাসের বিশেষ প্রশিক্ষণের দ্বারা তাদের পাশ করিয়ে দেওয়ার যোগ্যতায় উত্তীর্ণ করে দিতে হবে শিক্ষকদের। এ এক অদ্ভুত নিয়ম! চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত কিছু না জেনে আসা শিক্ষার্থীদের বড় অংশ পঞ্চম শ্রেণিতে হোঁচট খাবেই। ফেল করার পর দুমাসের বিশেষ কোচিং-এর মাধ্যমে যোগ্যতা মান অর্জন করিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই দুমাসের বিশেষ কোচিং-এর পর যদি বাধ্যতামূলক ভাবে তাকে প্রমোশন দিতেই হয় তাহলে আগের ব্যবস্থার থেকে এটির ভিন্নতা কোথায়? আবার তা যদি না করা হয় তাহলে পঞ্চম শ্রেণিতে প্রতি বছর বোঝা বাড়তে বাড়তে বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ভীড় জমতেই থাকবে। তাছাড়া এই বিশেষ ব্যবস্থার জন্য বিদ্যালয়গুলির পরিকাঠামো কোথায়? পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ এবং শিক্ষক কোথায়? দু মাস পিছিয়ে থাকার পর পরবর্তী শ্রেণিতে গিয়ে ঐ শিক্ষার্থী কিভাবে তাল মেলাবে? একইভাবে অষ্টম শ্রেণির ক্ষেত্রেও তা ঘটবে। তাই শিক্ষার মানোন্নয়নে পাশ-ফেল প্রথা চালুর সাথে সাথে শিক্ষাব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেলে সাজানোর প্রক্রিয়া শুরু হোক। এই আসল কাজটি করতে পারলে পাশ ফেল ব্যবস্থা আপনা থেকেই বিলুপ্ত হবে। কোনো শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে ফেল করার কোন প্রশ্নই আসবে না।

এই আসল কাজটি হবে বলে তো মনে হয় না। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকার শুধু পাশ সার্টিফিকেট দিতে চায়। শিক্ষার গুণগত মান ক্রমশ নিচের দিকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেবল ডিগ্রী পাক, কিন্তু বিচার, বুদ্ধি, বিবেক, শিরদাঁড়া সোজা করা মনুষ্যত্ব সৃষ্টির জায়গাটা যেন তৈরি না হয়। বাইরে থেকে শিক্ষার ঠাটবাটটি বজায় রাখা হচ্ছে আর ভেতরটাকে সুকৌশলে পুরোপুরি অন্তঃসারশূন্য করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষিত আর অশিক্ষিতের মধ্যে চেতনাগত ফারাকটা ক্রমশ কমছে! শিক্ষা কতটা পেল তা জরুরী নয়, পাশ করিয়ে খাতা কলমে শিক্ষার হার বাড়ানোই প্রধান উদ্দেশ্য। কারণ তারা ভালো করেই বোঝে ” ওরা যত বেশি জানে, ততো কম মানে।”

সর্বোপরি এ ব্যাপারে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্ব কোন অংশে কম নয়। নিজেদের অধিকারের পাশাপাশি কর্তব্যের জায়গাটিকে কোনোভাবেই দুর্বল করে দেওয়া যায় না। শিক্ষাকে রক্ষার জন্য শিক্ষকদেরই পথ প্রদর্শক হতে হবে। কেবল সমালোচনা নয়, শিক্ষাকে রক্ষার দাবিতে নিজেদের নিয়োজিত করা এবং কর্তব্যের জায়গাটিতে আরো দৃঢ় করে গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সামগ্রিক শিক্ষার মান উন্নয়ন সম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − three =