জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে, না জানে বাঁচাবে?

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে, না জানে বাঁচাবে?

তপন মল্লিক চৌধুরী :  ২০১৪ সাল থেকেই দেশের নতুন সরকার নতুন একটি জাতীয় শিক্ষানীতি প্রবর্তন করার চেষ্টা শুরু করে৷ ২০১৫ সালের গোঁড়াতেই সে বিষয়ে কথাবার্তা শুরু হয়। ২০১৬ সালের মে মাসে প্রাক্তন ক্যাবিনেট সেক্রেটারি সুব্রামনিয়াম কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একটি রিপোর্ট পেশ করেন। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ঐ বছরই একটি নথি প্রকাশ করে। তারপর ২০১৭ সালের জুন মাসে কস্তুরিরঙ্গনের নেতৃত্বে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষনীতি’ তৈরি করার জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটি ২০১৯ সালের ৩১ মে ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষনীতি–২০১৯’ জমা দেয়, যা গত ২৯ জুলাই মন্ত্রীসভার অনুমোদন পেয়ে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০’ নামে আত্মপ্রকাশ করে।

আসলে ২০১৬ সাল থেকে একটার পর একটা নথি পেশ হয়েছে। এরপর সবশেষে যেটি; সেটি হল জাতীয় শিক্ষানীতি–২০২০। কিন্তু এর মধ্যে যা আছে তা কি বিশেষ কিছু বা নতুন? একটু যদি ভেবে দেখি তাহলে আসল বস্তুটির মধ্যে কার্যত কোনও ফারাক সেভাবে চোখে পড়ে না। মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষার ওপর জোর ব্যাপারটা যে সোনার পাথর বাটি; সেটা আমরা অনেকদিন আগেই জেনে বুঝে গিয়েছি।  

মাধ্যমিক পরীক্ষার অবলুপ্তি ঘটানো, স্কুলে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেমেস্টার চালু, সংস্কৃত শিক্ষার উপর নতুন করে জোর দেওয়া, ইংরেজি শিক্ষার গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া- আসল উদ্দেশ্য কি?  শিক্ষক–ছাত্র পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে পরিচালিত শ্রেণি–কক্ষ শিক্ষার পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দেওয়া, কয়েকটি স্কুলকে একত্রিত করে সমষ্টি–স্কুল ব্যবস্থা চালু করা- এর পিছনে আসল কারণ কি? তিনটি অসম মানের বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি, ইউজিসি–এআইসিটিই প্রভৃতি ঐতিহ্যমণ্ডিত উচ্চশিক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থার অবলুপ্তি ঘটিয়ে হায়ার এডুকেশন কমিশন নামে একটি সংস্থা তৈরি করার জন্য কোন ভাবনা কাজ করছে তা আজ আর বোঝা খুব কঠিন কাজ নয়।

ভারত নামের সঙ্গে তত্ত্ব-দর্শন- ঐতিহ্য জুড়ে দিয়ে দেশ বা দেশীয় বিষয়কে গভীর কিংবা ওজনদার করা যায় যেমন, তেমনই ভারতীয়ত্ব  বললেই হিন্দুত্ব সুলভ কথাগুলিও এসে পড়ে। এই সব শব্দগুলির আড়ালে যে শিক্ষাকে গৈরিকীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণের ঝোঁক রয়েছে সেটা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয় না।  শিক্ষার জন্য জিডিপি–র ৬ শতাংশ বা কেন্দ্রীয় বাজেটের ১০ শতাংশ বরাদ্দ করা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতিগুলি সম্পূর্ণভাবে অনুপস্থিত থাকে। বরং  শিক্ষাকে দেশি–বিদেশি কর্পোরেট সংস্থার মুনাফা তৈরির উদ্যোগ ভীষণভাবে স্পষ্ট হয়। শিক্ষার বেসরকারিকরণ–বাণিজ্যিকীকরণ-কর্পোরেটকরণ ইত্যাদি যা আগের  নথিগুলির অংশ ছিল তা এবার চূড়ান্তভাবে অন্তর্ভুক্ত হল। আর এর  বেশীরভাগই শিক্ষায় আরএসএস–সঙঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডা।

ফের সেই গোঁড়ার প্রশ্নটি এসে পড়ল, তাহলে সরকার অন্যদের কোন মতকে গ্রহণ করলেন? যে দু’লক্ষ মতামতের ওপর ভিত্তি করে তাঁরা এই নতুন জাতীয় শিক্ষনীতি প্রণয়ন করলেন বলে দাবি করছেন তার সবগুলিই যে আসলে বিজেপি- আরএসএস–সঙঘ পরিবারের ইচ্ছা অনুসারী তা বললে কি খুব ভুল হবে?

লক্ষ্যণীয়, কেন্দ্রের আরএসএ গঠন করা নিয়ে যখন গোটা দেশ জুড়ে প্রতিবাদ শুরু হল, এমনকি গুজরাটের মত রাজ্যও প্রতিবাদ করল, তখন তাকেও বেনামে রাখার ব্যবস্থা হল৷  শুধু তাই নয়, বর্তমানে যে সেন্ট্রাল অ্যাডভাইসরি বোর্ড অফ এডুকেশন আছে তার হাতেই বেশী ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব এল। কারণ প্রতিবাদ মাথা চারা দিয়ে উঠেছে তাই এখন ঠেকে আর আরএসএ  নয়, সিএবিই কে আইনগতভাবে আরও বেশী ক্ষমতা দিয়ে শক্তিশালী করে চূড়ান্ত কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে কেন্দ্র দেশের সমস্ত স্তরের শিক্ষার উপর ছড়ি ঘোরানোর ব্যবস্থা করতে চাইছে৷

এর ফলে শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাধিকারের আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না।  শিক্ষার সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা হিসাবে গঠন করা হল সিএবিই, তার চেয়ারম্যান শিক্ষামন্ত্রী৷ অর্থাৎ সিএবিই চলবে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *