জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে না জানে বাচাবে? ২য় পর্ব

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে না জানে বাচাবে? ২য় পর্ব

 

তপন মল্লিক চৌধুরী : জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনও হেরফের যে ঘটাতে পারবে না তা বলাই বাহুল্য, বরং বিপদ ডেকে আনবে। যে কারণে কোনও শিক্ষাবিদ, শিক্ষক এবং চেতনাসম্পন্ন মানুষ একে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না। এখন সরকারি নিয়মে স্কুল স্তরে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক হিসাবে দুটি বোর্ডের পরীক্ষা হয়৷ প্রথম শ্রেণি থেকে শুরু হয় তারপর দুটি বোর্ডের পরীক্ষা হয়৷ প্রথম শ্রেণির আগে নার্সারি বা প্রি–স্কুল গ্রামে সরকারিভাবে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত৷ যদিও বেসরকারিভাবে নার্সারি স্কুল সারা দেশজুড়ে আছে৷

নতুন নীতিতে (১০+২)–র পরিবর্তে (৫+৩+৩+৪) প্রথা চালু করা হবে। এর ফলে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র যা ৩–৫ বছর তাকে স্কুল শিক্ষার মধ্যে আনা হবে। তার সঙ্গে ২ বছর অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আমরা জানি, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের কর্মী বা সহায়িকাদের আসলে শিশু, তাদের মায়েদের দেখাশোনা ও রান্না করা খাবার দেওয়ার দায়িত্ব আছে এবং তার জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত৷ কিন্তু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস নেওয়ার জন্য যে যোগ্যতামান, তা তাঁদের থাকে না৷

আরও পড়ুন- জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০ শিক্ষাকে প্রাণে মারবে, না জানে বাঁচাবে? প্রথম পর্ব

এবার তাঁদের ওপর প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিকে পড়ানোর দায়িত্ব পড়বে৷ এর জন্য পরিকাঠামোগত বা উপযুক্ত শিক্ষকের সমস্যা হবেই। তাছাড়া অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলি এমনিতেই অর্থাভাবে ধুঁকছে সেগুলি আরও বিপর্যস্ত হবে। পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষা ব্যবস্থাও লাটে উঠবে। ৩ থেকে ৫ বছরকে স্কুল পর্যায়ে নিয়ে এসে সরকার যে আন্তর্জাতিক স্তরে দেশ উন্নীত হবে বলে যে গর্ব করছেন, আসলে তারা ক্ষতির কথাটা মাথায় রাখছেন না৷

নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিকে তাঁরা ৪X২= ৮টি সেমেস্টারে ভাগ করেছেন৷ কিন্তু কলেজ স্তরের সেমেস্টার প্রথার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তাঁরা জানেন যে আসলে তাতে সর্বাঙ্গীন শিক্ষা ও জ্ঞানের গভীরতা কিভাবে ব্যাহত হয়। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেদিকে কর্ণপাত করতে রাজি নয়। সরকার কলেজ স্তরে যে ব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসুবিধাজনক তাকে বিদ্যালয় স্তরে চালু করবে বলে ঠিক করেছেন। কিন্তু এর ফলে স্কুল স্তরে বুনিয়াদী শিক্ষার বুনিয়াদটা ভেঙে পড়তে পারে। কেবল সেখানেই শেষ হচ্ছে না। দশমের পর মাধ্যমিক বা যে বোর্ড পরীক্ষা, তাতে পাশ করলে সার্টিফিকেট পাওয়া যায় সেটাই লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন- বই খুলে দেওয়া যাবে পরীক্ষা, নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের

এখনও এ দেশে মাধ্যমিক–পাশ করে সরকারি ও বেসরকারি নানা ধরনের চাকরি পাওয়ার একটা সুযোগ আছে, সেই যোগ্যতাকে এখনও মান্যতা দেওয়া হয়। দশম শ্রেণির পর বোর্ড পরীক্ষার তুলে দিতে চাইছে সরকার। তার জায়গায় বিদ্যালয় স্তরের শেষ পরীক্ষা দ্বাদশে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিপদ তো একটা নয়, একাধিক। দশমের পর বহু ছাত্রের আর পড়াশুনা হয় না। তারা কি আর শংসাপত্র ছাড়া এখন থেকে কোনও কাজকর্ম পাবেন? ‘ড্রপ–আউট’ না হয়েও যাদের শুধুমাত্র সংশাপত্র পাওয়ার জন্য টিকে থাকতে হবে আরও দু’বছর, তারা কিভাবে টিকে থাকবেন তা সরকারও জানেন না ওইসব ছাত্রছাত্রীরাও না।  তাহলে কি বুঝতে হবে যে এ দেশের কোটি কোটি নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যত এখান থেকেই শেষ হওয়া শুরু? 

অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেএই শিক্ষানীতি। সরকার পরিকল্পনা করেছে ৫০ শতাংশর বেশি পডুয়াকে এর অন্তর্ভুক্ত করবে৷ স্নাতক–ডিগ্রি দেবে এমন কলেজও তাঁরা খোলার অনুমতি দিচ্ছেন যাতে ১০০ শতাংশ অনলাইন শিক্ষা চালু হয়। শিক্ষা ব্যবস্থা হবে কম্পিউটার–ল্যাপটপ ভিত্তিক। এই শিক্ষা নীতি অনুযায়ী আর স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের দরকার হবে না। লাইব্রেরি–ল্যাবরেটরির উন্নয়ন দরকার পড়বে না। সস্কুল-কলেজ যখন নেই তখন  শিক্ষক নিয়োগেরও প্রশ্ন নেই। নতুন শিক্ষকও আর দরকারহবে না।  ফলে সরকারের আর্থিক দায়িত্ব অনেকটাই কমে যাবে। তাহলে থাকবে কি?

আরও পড়ুন- অক্টোবরে নয়, পরীক্ষা হোক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইচ্ছাতেই, দাবি জুটার

এখন দরকার শুধু অ্যাপ কিংবা লেকচারের ভিডিও। যা মিলবে ইন্টারনেট সম্পন্ন কম্পিউটার–ল্যাপটপ থেকে৷ সেখান ঠেকে শুনে শুনে পড়াশোনা হবে৷ এবার প্রশ্ন এই শিক্ষা ব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবে কারা? নিশ্চয় আপামর জনসাধারণ নয়। যদিও  দেশের যতজন মানুষের মোবাইলফোন আছে ততজনের শৌচাগার নেই। কিন্তু তাহলেও দায়িত্ব নিয়ে বলা যায় দেশের ধনী পরিবারের ছেলেমেয়ে ছাড়া ছাড়া আর কেউই এই শিক্ষা নীতিতে ঠাই পাবে না৷

লকডাউনের সময়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন পডুয়া ও তাঁর অভিভাবক যন্ত্র না থাকা আর প্রযুক্তির জটিলতা সামাল দিতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন৷ তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নি প্রত্যেকের হাতে পৌঁছে যাবে কম্পিউটার–ল্যাপটপ। কিন্তু তাতেই কি দীর্ঘদিনের প্রচলিত ব্যবস্থা উড়িয়ে দিয়ে, শিক্ষক–ছাত্রের সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা শ্রেণিকক্ষ শিক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষাকে বিকল্প হিসাবে মেনে নিতে পারবো? 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

nineteen − two =