ঝাড়গ্রাম: ঋষি-কবিদের কথায় বিন্দু বিন্দু-তেই সিন্ধু৷ ‘সিন্ধু’ অর্থাৎ সমুদ্র, জ্ঞানের সমুদ্র৷ এই ভাবনা থেকেই শুরু হয়েছিল শিক্ষক রাজীব দাসের ‘বিন্দুর পাঠশালা’৷ ঝাড়গ্রামের বাঁশতলা জুনিয়র হাইস্কুলের শিক্ষক তিনি৷ এই স্কুলেরই বারান্দায় প্রতি শনিবার দুপুরে বসে তার এই পাঠশালা৷ গ্রামেরই ৩০ জন বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে তার স্বাক্ষরতা অভিযান৷
তবে তার এই অভিযানের শুরুটা ছিল পুরোটাই অনিশ্চয়তায় ভরা৷ জানতে হলে ফিরে যেতে প্রায় দশ বছর আগে৷ যেদিন মাওবাদী উপদ্রুত ঝাড়গ্রাম শহরের উপকন্ঠে জঙ্গলঘেরা বাঁশতলা গ্রামে স্কুল শিক্ষক এর চাকরি নিয়ে আসেন, নদীয়া জেলার রাজীব দাস৷ একের পর এক মাওবাদী হামলার জেরে তখন খবরের শিরনামে পশ্চিম মেদিনীপুরের জঙ্গলমহল৷ আকাশ বাতাস, জুড়ে বারুদের গন্ধ, মাওবাদী অস্থিরতা তুঙ্গে৷ যে মানুষ গুলোর জন্য শিক্ষার আয়োজন, তাদের পেটে ভাত নেই,নেই সুশিক্ষা,কুসংস্কারের অন্ধকারে ডুবে আছে তাদের মন৷
একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হবে বুঝতে পারেন রাজীব বাবু৷ মাত্র চার জন পড়ুয়াকে নিয়ে স্কুল শুরু করেন৷ কিন্তু, নিদারুন দারিদ্রতার চাপে ঝিমিয়ে পড়া শৈশবগুলো যে শুধুমাত্র প্রথাগত শিক্ষাতে টান অনুভব করবেনা তার বেশ বুঝেছিলেন৷ তাইতো পড়াশোনার পাশাপাশি,শাল তলায় শুরু করেন ,‘আনন্দ পাঠ’৷ গান,কবিতা,আঁকা, প্রকৃতি দেখা,সাথে মুড়ি চানাচুর,ধীরে ধীরে,অনেক কঁচি কাঁচারা এসে ভিড় জমাতে শুরু করল রাজীব মাস্টার এর আনন্দ পাঠে৷ হঠাৎ করেই তাঁর মনে হল যে এই শিক্ষার্থীরা বেশিরভাগই নিজেদের পরিবারের প্রথম প্রজন্মের স্বাক্ষর সদস্য তাই তাদের মায়েদের স্বাক্ষর করে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি নিজ উদ্যোগে চালু করেন এই ‘বিন্দুর পাঠশালা৷’
পড়াশোনার পাশাপাশি, শালতলায় শুরু হল, ‘আনন্দ পাঠ’ গান, কবিতা, আঁকা, প্রকৃতি দেখা, সঙ্গে মুড়ি চানাচুর৷ অনেক কঁচি কাঁচারা এসে ভিড় জমাতে শুরু করল রাজীব মাস্টারের আনন্দ পাঠে৷ তিনি এটাও বুঝেছিলেন যে তাঁর যারা শিক্ষার্থী তারা বেশিরভাগই নিজেদের পরিবারের প্রথম প্রজন্মের স্বাক্ষর সদস্য এবং তাই সেই পরিবারের বড়দের স্বাক্ষর করার বিষয়ে উদ্যোগী হলেন৷ এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মায়েদেরই প্রাধান্য দিলেন৷ তাদের জন্যই তৈরি করলেন ‘বিন্দুর পাঠশালা’৷ এখন হেঁসেল, বাইরের কাজ সামলেও নিয়ম করে স্লেট-চক নিয়ে বসছেন উমারানি মাঝি, সন্ধ্যা মাঝি, সাবিত্রী মাঝি, বিমলা মান্নারা৷ কাঁপা কাঁপা হাতে শিখছেন অ-আ, ক-খ৷ শিক্ষক ওঁদেরই স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি৷
এর পাশাপাশি এই শিক্ষক গ্রামের মায়েদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতেও উদ্যোগী হয়েছেন৷ বাঁশতলা গ্রামের মায়েদের নিয়ে তিনি ৭-৮ খানি স্বনির্ভর গোষ্ঠী খুলেছেন যার প্রতিটির নাম তিনি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নায়িকার নামে, যেমন – ‘উত্তরা’, ‘চারুলতা’ ইত্যাদি৷ প্রতিটি গোষ্ঠী আলাদা আলাদা কাজের সঙ্গে যুক্ত, যেমন, স্থানীয়ভাবে গয়না তৈরি, বিভিন্ন রকম পোশাকআশাক বানানো, মিষ্টি-পাঁপড় ইত্যাদি খাদ্যসামগ্রী তৈরি৷ প্রত্যেক গোষ্ঠীর জন্য আলাদা আলাদা ব্যাংক অ্যাকাউন্টও খোলা হয়েছে, যাতে আর্থিক লেনদেনের অসুবিধা না হয়৷
কোনও সরকারি সুবিধাই পেতোনা এই এলাকাবাসী৷ কিন্তু রাজীব মাস্টারের প্রচেষ্টায়, বর্তমানে তাদের সমস্ত সুবিধা দিচ্ছে রাজ্য সরকার৷ তাই রাজীববাবু চাইছেন এখানকার মানুষ যেন নিজেদের প্রাপ্য বুঝে নিতে পারে৷ আর নতুন প্রজন্ম যেনো তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে পারে৷