কলকাতা: সুপার সাইক্লোন ফনির সতকর্তা হিসেবে স্কুল ছুটি ঘোষণা আগেই করছে রাজ্য। এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে গরমের ছুটিও। সবমিলিয়ে ছুটির সংখ্যা গিয়ে ঠেকেছে দু’মাসে। আজ ৩ মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত এই ছুটির খবরে গোটা রাজ্যজুড়েই শোরগোল পড়েছে। শিক্ষকদের তরফে প্রশ্ন তোলা হয়, গরমের ছুটি ঘোষণা হলেও শিক্ষকরা ঘূর্ণিঝড় মাথায় নিয়ে স্কুলে যাবেন কি না৷ এই নিয়ে তৈরি হয় ধোঁয়াশা৷ শিক্ষকদের ক্ষোভের আঁচ পেয়ে বৃহস্পতিবার নয়া বিজ্ঞপ্তি জারি করে ধোঁয়াশা কাটাল বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর৷ এবার আজ, শুক্রবার দুপুরে স্কুল ছুটির বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছুটির নির্দেশিকা স্পষ্ট করল শিক্ষা দপ্তর৷
বৃহস্পতিবার দুপুরে ফনির জন্য ‘স্কুল ছুটি’র নবান্নের নির্দেশিকা নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল চূড়ান্ত ধোঁয়াশা। সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছিল ক্লাস সাসপেন্ডেড৷ স্কুল ছুটিতে শিক্ষকরা কী করবেন, সেই ধোঁয়াশা কাটাতে আজ নয়া বিজ্ঞপ্তি জারি করল শিক্ষাদপ্তর৷ নয়া বিজ্ঞপ্তি জানানো হয়েছে, বিধ্বংসী ফনির কারণে আজ শুক্রবার ও শনিবার ছুটি থাকছেই৷ সঙ্গে জুড়ছে গরমের ছুটিও৷ নতুন নির্দেশিকা জারি করে স্কুল শিক্ষা দপ্তরের তরফে জানানো হয়েছে, ৩০ জুন পর্যন্ত রাজ্যের সমস্ত সরকারি, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষকদের জন্যেও ছুটি থাকবে৷ ফলে, শুধু পড়ুয়াদের জন্য নয়, টানা দু’মাস ছুটি পাবেন রাজ্যের সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা৷ আগামী ৬ মে থেকে গরমের ছুটি পড়ার কথা থাকলেও আজ থেকেই টানা দু’মাস ছুটি হয়েছে স্কুল৷ ৩০ জুন পর্যন্ত টানা ছুটি পাবেন সরকার ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষকেরা৷
বৃহস্পতিবার রাতে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে, আজ শুক্রবার ও শনিবার পুরোপুরি ছুটি থাকবে রাজ্যের সমস্ত স্কুল৷ ফনির বিপর্যয় ও নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে আট জেলায় স্কুল ছুটির ঘোষণা করা হয়৷ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে, দুই মেদিনীপুর, দুই ২৪ পরগনা, ঝাড়গ্রাম, হাওড়া ও কলকাতায় সমস্ত স্কুল বন্ধ রাখা হবে৷ একই সঙ্গে মাদ্রাসা শিক্ষা দপ্তর থেকেও ৩ ও ৪ তারিখ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে৷ ফনি প্রভাবিত আট জেলার জন্য তা কার্যকর হবে৷ এবার সেই বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে টানা ছুটি জুড়ল৷
অন্যদিকে, টানা দু’মাস ছুটির খবরে চাপা অসন্তোষ দানা বেঁধেছে শিক্ষক মহলে৷ প্রকাশ্যে সরব হয়েছে বেশকিছু শিক্ষক সংগঠন। গরমের ছুটিতে শিক্ষকদের কী আসতে হবে স্কুলে? বিজ্ঞপ্তিতে ধোঁয়াশা শিক্ষকদের মধ্যে৷ কেন স্পষ্ট করে জানাচ্ছে না শিক্ষা দপ্তর? শিক্ষকদের তরফে এহেন অভিযোগ তোলা হলেও বিজ্ঞপ্তি ঘিরে বিতর্কের ঝাঁঝ আরও বাড়িয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী৷ বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শিক্ষকদের কী খুব গরম লাগছে? সরকারি কর্মচারীদের গরম লাগে না? শুধু শিক্ষকদের গরম লাগবে? সরকারি কর্মচারীদের গরম নেই৷ গরমের ছুটিতে যা নিময় আছে, তাই তাঁরা পালন করবে৷ কোনও অসুবিধা নেই তো তাতে৷’’
রাজ্যের দেওয়া বিজ্ঞপ্তি ঘিরে চূড়ান্ত ক্ষোভ করছে একাধিক শিক্ষক সংগঠন৷ মাধ্যমিক শিক্ষকও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ মিত্র বলেন, আজকে রাজ্যের শিক্ষা দপ্তর যেভাবে ফনি ঝড়ের নাম করে ও গরমের দোহাই দিয়ে ৩মে থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত পঠনপাঠন বন্ধ করার যে নির্দেশ দিলেন তা এককথায় অত্যন্ত অযৌক্তিক। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। মনে করি সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলি এইভাবে প্রতিবছর বন্ধ রেখে দিয়ে পশ্চিম বাংলার সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হচ্ছে। একদিকে প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলি স্কুল চালু রাখবে, অপরদিকে সরকারি বিদ্যালয় গুলোতে পঠন-পাঠন বন্ধ থাকবে যার ফলে অভিভাবকদের মধ্যে একটা ধারণা জন্মাবে যে সরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ থাকছে না। আগামী দিনে সরকারি বিদ্যালয় স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র-ছাত্রী আসা কমবে। সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করছি আপনি অবিলম্বে এই ধরনের আত্মঘাতী সার্কুলার প্রত্যাহার করুন এবং অবিলম্বে বিদ্যালয়ের পঠন পাঠনের ব্যবস্থা করুন তা না হলে পশ্চিমবাংলার শিক্ষক সমাজ এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলবে।
এবিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষকও শিক্ষাকর্মী সমিতির দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক অনিমেষ হালদার বলেন, ‘‘বিশেষ পরিস্থিতিতে শিক্ষা দপ্তর অবশ্যই অতিরিক্ত ছুটি ঘোষণা করতে পারে। কিন্তু ঝড় ও গরমের জন্য দু’মাস ছুটি ঘোষণা করা একটা হাস্যকর সিদ্ধান্ত। শেষ কয়েক বছর অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে একটার পর একটা বিতর্কিত অর্ডারের জন্য বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা৷’’
ছুটি প্রসঙ্গে শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের যুগ্ম সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস(ফনি) এবং অত্যধিক গরম আবহাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের নির্দেশে শিক্ষা দপ্তর হঠাৎ করে বিদ্যালয়গুলিতে দু’ মাস যাবৎ পঠন পাঠন বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি করেছে। ঝড়ের পূর্বাভাসের ফলে ছুটি ঘোষণার সিদ্ধান্তকে আমরা নিশ্চয়ই সমর্থন জানাই। বাস্তব পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অত্যধিক গরমের জন্য কিছুদিন বিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তকেও অস্বীকার করি না। কিন্তু শিক্ষা দপ্তর থেকে ২মে, যে নোটিফিকেশন করা হয়েছে তা এককথায় নজিরবিহীন। এই পরিস্থিতিতে একটানা প্রায় ২ মাস বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন বন্ধ রাখার নির্দেশ সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার উপর বিরাট আঘাত। এই খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত সারা রাজ্যের ছাত্র ও অভিভাবকদের মধ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে ঘৃণা এবং প্রবল অনীহার সঞ্চার করবে যা সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে অতি দ্রুত রসাতলের দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে। এর দ্বারা সুকৌশলে সরকার অভিভাবকদের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেদের দায় দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইছে। আর শিক্ষার করুণ পরিণতির জন্য শিক্ষকদের কাঠ গড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে এবং হবে। এছাড়া সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শিক্ষামন্ত্রী শিক্ষকদের সম্পর্কে যেভাবে তির্যক মন্তব্য করেছেন তা অত্যন্ত কুরুচিকর। আমরা সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আমাদের দাবি– ১. অবিলম্বে দীর্ঘ দু’মাস যাবৎ পঠন-পাঠন বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রত্যাহার করতে হবে। ২. পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বের ন্যায় বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা গুলির জন্য বছরে ৮০টি ছুটির সার্কুলার ফিরিয়ে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যালয়গুলিকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দিতে হবে। ৩. নিজেদের ব্যর্থতার দায় অন্যদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষকদের সম্পর্কে তীর্যক ও অসম্মান সূচক মন্তব্য প্রত্যাহার ও বন্ধ করতে হবে।’’