কলকাতা: ফাইল উপচে পড়েছে উচ্চশিক্ষার সংশাপত্রে৷ কিন্তু প্রাপ্তির ভাণ্ডার শূন্য! চারিদিক ঘিরে রয়েছে শুধুই হতাশা৷ কারণ শিক্ষার প্রাঙ্গণকেও আজ এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে নেপোটিজম৷ শুধুমাত্র মথার উপর ‘গডফাদার’-এর আশীর্বাদে কলেজের অতিথি শিক্ষকরা হয়ে উঠছে স্থায়ী শিক্ষক৷ সর্বস্তরে বঞ্চিত হচ্ছে প্রকৃত মেধা৷ রাজনীতির ঘোলা জলে শিক্ষা আজ বিপন্ন৷ শিক্ষায় লেগেছে রাজনীতির রং৷ উঠছে অভিযোগ৷ আগামী দিনে কী শিক্ষা পাবে আগামী ভবিষ্যৎ প্রজন্ম?
যদিও এই নেপোটিজম বা স্বজনপোষণের ইতিহাস নতুন নয়৷ মহাভারতেও একইভাবে বঞ্চিত হতে হয়েছিল একলব্যকে৷ গুরুদক্ষিণার নামে কেটে নেওয়া হয়েছিল তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুল৷ সেযুগে গুরু দ্রোণাচার্জের নেপোটিজমের শিকার হয়েছিলেন একলব্য৷ আর আজকের একলব্যরা নেট, সেট, এম.ফিল, পিএইচডি পাশ করে ঝোলা বোঝাই ডিগ্রি নিয়ে বেকার হয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে৷ মান জুটছে না যোগ্যতার৷
আজ মেধাবীদের জন্য বড়ই দুঃসময়৷ উচ্চাশা কমিয়ে আশেপাশের দিকে তাকালে চমকে উঠতে হয়৷ টেট পাশ করা আপার প্রার্থীরা স্কুলে চাকরি পাওয়ার প্রতীক্ষায় সাত বছর কাটিয়ে ফেলেছে৷ আবেদন, অনুনয়, বিক্ষোভ সবই বৃথা৷ একে শিক্ষার উপহাস ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? তবে কি তাঁরা তাঁদের শিক্ষার মূল্য পাবে না?
হাতজোড় করে সুযোগের প্রার্থনা জানানো ছাড়া আর উপায়ই বা কি তাঁদের? নিজেদের মেধাকে সুস্থ পরিবেশে শান্ত মনে আরও বৃহত্তর গবেষণার কাজে লাগানোর জন্য ছটফট করছে এই বঞ্চিতের দল৷ তাই তাঁদের কাতর আর্তি, ‘‘একটা সুযোগ দিননা..৷ আমাদের মধ্যে থেকেই হয়তো কেউ হয়ে উঠবে রাকেশ শর্মা বা কল্পনা চাওলার মতো একজন!’’ দেশের জন্য অনেক কিছু করার ইচ্ছা আজও ভর করে রয়েছে তাঁদের দু’চোখের পাতায়৷ তবে রাকেশ শর্মা বা কল্পনা চাওলার মতো নামগুলোও কয়েক দশক ধরে আর শোনা যায় না৷ শোনা যাবেই বা কী করে৷ আজ অঙ্ক বা ফিজিক্সে এমফিল করা ছেলেরা ডাল-চাল যোগানের গবেষণা করছে৷ স্কলারশিপে কি আর পুরো জীবন চলে?
ছোট থেকে যে ছেলেমেয়েগুলো দু’মলাটে মুখ গুঁজে কাটিয়ে দিল, তাঁদের পায়ের তলায় ভিতটুকুও পাকা হল না৷ বরং সরকারের এ দফতর, ও দফতর ঘুরে ছিন্নভিন্ন হল তাঁদের পাদুকা৷ ‘ভোট ব্যাংক’ – এই একটি শব্দটা বড্ড জটিল আর কঠিন করে তুলেছে মেধার লড়াইকে৷ রাজনীতির হত্তাকত্তাদের পায়ে তেল দিয়ে রাজনীতির চাদর গায়ে জড়িয়ে কলেজে অতিথি অধ্যাপকের আসনে বসে পড়েছে নেট-সেট ছাড়া একদল সাধারণ মাস্টার ডিগ্রি পাশ করা ছেলেমেয়েরা৷ রাজনীতির দাক্ষিণ্যে তাঁরাই এখন এসইসিটি পদে স্থায়ী শিক্ষক৷ আর নেট-সেট পাশ করে এমফিল বা পিএইচডি করা ছেলেরা হোঁচট খেয়ে বেরাচ্ছে কলেজের চৌকাঠে৷ এটা কি শুধুই আমাদের ভাগ্যের পরিহাস? নাকি একদল ক্ষমতালোভীর লিপ্সার পরিণাম?
এই যদি শিক্ষার চিত্র হয়, তাহলে বছরের পর বছর ধরে সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যে ৭টা পর্যন্ত ল্যাবে থেকে এমফিল করা বা নেট, সেট পাশ করে কী লাভ! এর জন্য কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে, তা কেবল সেই সকল ছাত্রছাত্রীরাই জানে৷ রাত জেগে পড়াশোনা, থিসিস লেখা সবই বুঝি বৃথা হতে বসেছে৷ ল্যাব রুম থেকে দেখা পৃথিবীটা যে সম্পূর্ণ অন্য রকম তা বুঝতে পারেন স্বপ্নে বিভোর চোখগুলো৷ ডিগ্রি নিয়ে বেরনোর পর তাঁরা দেখল তাঁদের যোগ্যতার সিটটাই নেই৷ কেউ আগে থেকে আছে বলেই এসইসিটি হয়ে গেছে৷ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আপোশ মানায় না৷ বিশেষ করে শিক্ষা আর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে তো নয়ই৷ যোগ্যতার মূল্য না দিয়ে রাজনীতির রং বিচারে যদি কলেজে শিক্ষকতার সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোয়ালিটি এডুকেশন পাবে কি করে? যোগ্যতার সঙ্গে আপোশ না করে প্রতিভা বিচার করে যোগ্য স্থান দেওয়া হোক, এটুকুই চাহিদা৷ না হলে .. ‘‘খনির ভিতরে থাকা হিরেটা খনিতেই থেকে যাবে৷ কেউ জানে না আমাদের কথা৷ আশেপাশে থেকে যাবে হতাশা৷’’