সরকারি ভাবনায় শিক্ষা: হীরক রাজাদের উদ্দেশ্য আমরা সফল করে তুলছি না তো?

সরকারি ভাবনায় শিক্ষা: হীরক রাজাদের উদ্দেশ্য আমরা সফল করে তুলছি না তো?

61a61c089c89488baa5d4bbfe4d2c868
e89ef4a623147845d333bc0c064798cf
কিংকর অধিকারী

কিংকর অধিকারী: কোভিড পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলেই কঠোর ভাবে কভিড বিধি মেনে শিক্ষালয় গুলিতে পঠন-পাঠন শুরু করার দাবি তুলে ধরলে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এমনকি কিছু সংখ্যক মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকাও বলেন, “এর ফলে যদি একজনও ছাত্র-ছাত্রীর প্রাণহানি ঘটে তাহলে তার দায় নেবেন তো?” “আপনার বাড়িতে কি স্কুলে পড়া ছেলে মেয়ে রয়েছে?” “আপনি কি তাদের শিক্ষালয়ে পাঠাবেন?” “আপনার নিজের যদি সন্তান থাকতো তাহলে এই দাবি করতে পারতেন না।” ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাঁদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমার পক্ষে সুবিধা হলো এই যে, আমার সন্তানরা বিদ্যালয়ে পাঠরত। কিছুদিনের জন্য যখন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পঠন-পাঠন শুরু করা হয়েছিল তখন আমার সন্তান নিয়মিত বিদ্যালয়ে গিয়েছে। আমি তাকে বিদ্যালয় পাঠিয়েছি। নিয়মকানুন মেনে চলার কথা বলেছি। আবার যদি নিয়মকানুন মেনে বিদ্যালয় পঠন-পাঠন শুরু করা হয় তাহলে আবার পাঠাবো।

এবার আসি আরেকটি প্রশ্নের উত্তরে। আগামী পাঁচ বছর যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে তাহলে কি সব অচল হয়ে থাকবে? যখন ভাইরাস সংক্রমণের চূড়ান্ত সময় তখন নিশ্চয়ই আমাদের যেভাবে নিয়ম মেনে চলার তা মেনে চলতে হবে। আর যখন সংক্রমণের প্রভাব কিছুটা কম তখনও কি একইভাবে ঘর বন্দী অবস্থায় থাকবো? নিয়ম মেনে তাদের কি জীবনের প্রয়োজনে বাইরে পাঠাবো না? বিপদের আশঙ্কায় জীবন এভাবেই চলতে পারে? যাঁরা প্রশ্ন তুলছেন – যদি একজন ছাত্র বা ছাত্রীর প্রাণহানি ঘটে তার দায় কে নেবে – তাঁদের বলি স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা যখন আমাদের সন্তানকে বিদ্যালয় পাঠিয়ে দিই  তখন রাস্তাঘাটে বা খেলার মাঠে পাঠিয়ে দিই তখনও কি একেবারে কোনো অঘটনের আশঙ্কা থাকে না? আমরা কি এই আশঙ্কায় সন্তানকে সব সময় ঘর বন্দি করে রেখে দিতে পারি? আশঙ্কা সেই অর্থে সব সময় রয়েছে। একটার পর একটা ঢেউ আসবে। সচেতনভাবে আমাদের তাকে মোকাবেলা করতেই হবে। কিন্তু যখন সবকিছু সচল হবে আর কেবল শিক্ষার দরজাটাকে বন্ধ করে রাখা হবে তখন তা কি মেনে নেওয়া যায়?

আবার আমরা উপযুক্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ছাত্র ছাত্রীদের ভ্যাকসিনের দাবী করছি ঠিকই কিন্তু এই ভ্যাকসিন কি ভাইরাস প্রতিরোধে ১০০%  নিশ্চিত? না, নিশ্চিত নয়। এমনকি ভ্যাকসিনের বিষয় নিয়ে সারা বিশ্বে ডাক্তার, বিজ্ঞানী মহলে মতদ্বৈততা দেখা দিচ্ছে। ভ্যাকসিন দিলেই যে নিশ্চিত একথাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তার উপর সম্প্রতি আমাদের রাজ্যে যে ভ্যাকসিন বিভ্রাট ঘটেছে তা সকলকে আরো বেশি আতঙ্কিত করে তুলেছে। তাহলে এই অবস্থায় আমরা কি করব? সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীদের বছরের-পর-বছর বিনা পাঠে, বিনা পরীক্ষায় প্রমোশন দেওয়ার সরকারি নীতিকে দুহাত তুলে সমর্থন করবো তো?

আর বছর বছর এভাবে বিনা ক্লাসে, বিনা পরীক্ষায় ভুরিভুরি নম্বর দিয়ে সকলকেই পাশ করিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শিক্ষার মানকে এক ধাক্কায় কোথায় নিয়ে যাবে একবার ভেবে দেখেছেন কি? গত বছর থেকে যারা যে ক্লাসে ছিল তারা প্রায় দু’ বছরের শূন্যস্থান নিয়ে আগামী দিনে দুটি উঁচু ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। এতে সত্যিই কি তাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে? চাকরি-বাকরির কথা ছেড়েই দিলাম। এর বাইরেও সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয়ে তাদের স্বচ্ছ ধারণা, চিন্তাভাবনা, যুক্তি, বিজ্ঞান মনষ্কতা যা সামগ্রিক সমাজ ও সভ্যতাকে সমৃদ্ধ করে তার বিন্দুমাত্র উপলব্ধি গড়ে উঠবে কি এই প্রক্রিয়ায়? শিক্ষার মূল্য তো সেখানেও। সেখানেও বিরাট একটা শূন্যস্থান তৈরি হবে।

অবশ্য এ কথা ঠিক ‘ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে’ হীরক রাজার সেই কৌশল নিয়ে যারা চলছে তারা তো প্রকৃত শিক্ষায় নয়, শুধু ডিগ্রিধারী তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিত মানুষ তৈরি করতে চাইবে। এমন শিক্ষিত মানুষই তো তাদের চাই, যারা কোনো প্রশ্ন করবে না, যুক্তি দিয়ে ভাবনাটাকে সাজাতে পারবে না, সবটাই ‘কপালের দোষ’, ‘পূর্ব জন্মের পাপের ফল’ ইত্যাদির দোহাই দিয়ে নিজেকেই দোষারোপ করতে শিখবে। অন্যায়টাকে যুক্তি দিয়ে জোর গলায় অন্যায় বলতে শিখবে না। যুগে যুগে শাসকেরা সব সময় এটাই চেয়েছে। কেবল আজকেই নয়, এই প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন থেকেই শিক্ষাব্যবস্থায় চালু রয়েছে। যেটুকু অবশিষ্টাংশ রয়েছে সেই গুণমানকেও নামিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। আমরা হীরক রাজাদের সেই উদ্দেশ্যটাকে সফল করে তুলবো তো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *