কিংকর অধিকারী: সম্প্রতি সংবাদে প্রকাশ পশ্চিমবঙ্গের মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাতটি বিষয়ের জায়গায় পাঁচটি বিষয়ে পাশ করলে এবার থেকে পরীক্ষার্থীকে পাস করিয়ে দেওয়ার ভাবনা চিন্তা চলছে। সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষাপ্রেমী মানুষের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে যাঁরা সুপারিশ করেছেন তাঁরা এবং কিছু শিক্ষিত মানুষ মনে করেন অন্যান্য বোর্ডে এরকম ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তাহলে আমাদের রাজ্যে তা লাগু করতে অসুবিধা কোথায়?
একথা ঠিক, শুধু আমাদের রাজ্যে নয়, সর্বভারতীয় স্তরে সিবিএসই, আইসিএসই বোর্ড গুলিতে একইভাবে বেস্ট অফ ফাইভ পলিসি চালু হয়েছে। আমাদের রাজ্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও তা লাগু হয়ে গিয়েছে। সে দিক দিয়ে বিচার করলে পশ্চিমবঙ্গে এটি নতুন নয়। কেবল অনুকরণ মাত্র।
এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমার মনে হয় শিক্ষাকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখবো সেটা আগে ঠিক করে নেওয়া দরকার। যদি মনে করি শিক্ষা বিষয়টি কেবলমাত্র অর্থ রোজগারের একটি ছাড়পত্র বা কেবল দামী অলঙ্কারের মতো শোভা বৃদ্ধির একটি বিষয় কিংবা নামে-ডাকে, খাতা-কলমে সারা রাজ্যে এক ধাক্কায় উচ্চ শিক্ষার হার বাড়িয়ে অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিতের হার কমিয়ে ফেলা উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এই পদক্ষেপের বিকল্প নেই।
আপনারা অনেকেই জানেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কাছে একবার এক ইংরেজ সাহেব সুপারিশ করে বলেছিলেন যে, ইউরোপিয়ানরা অনেক কষ্ট করে এদেশে এসে প্রয়োজনের তাগিদে দেশীয় শিক্ষা গ্রহণ করছে। তাদের বৃথা কষ্ট না দিয়ে (ফেল না করিয়ে) পাশ করিয়ে দিলে কেমন হয়? বিদ্যাসাগর সেই সাহেবের চোখের উপর চোখ রেখে বলেছিলেন প্রকৃত যোগ্যতা অর্জন না করলে কোন মতেই তাঁর পক্ষে পাশ করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। বিদ্যাসাগর মশাই গণশিক্ষার পক্ষে লড়াই করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তিনি আগাগোড়াই মনে করতেন গণশিক্ষার নামে যেন গুণগতমান নষ্ট না হয়। যেটুকু শিক্ষার বিস্তার ঘটবে তা যেন প্রকৃত মান অর্জনে সহায়ক হয়। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে তিনি এভাবেই ঢেলে সাজাতে চেয়ে ছিলেন।
বিদ্যাসাগরের সময় থেকে বর্তমানে অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা। তাঁর চিন্তাভাবনার থেকে যদি আরো উন্নত চিন্তা গ্রহণ করতে পারি তাহলে তা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তা তো দূরের কথা বর্তমানে গুণগত মান অর্জন না করে অর্থের বিনিময়ে বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করার যে সংস্কৃতি শুরু হয়েছে তা আদতে গোটা দেশ বা রাজ্যের চেতনাগত সংস্কৃতিকে নিম্নগামী করছে ক্রমাগত। শিক্ষার নিচের স্তরে কিছু না জানলেও সহজে তরতরিয়ে উঁচু ক্লাসে উঠে যাওয়ার সরকারি নীতি(অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিছু না জানলেও পরবর্তী ক্লাসে প্রমোশন) আর উপরের স্তরে সরকারি ও বেসরকারি প্রচেষ্টায় প্রচুর অর্থের বিনিময়ে ডিগ্রী কিনে নেওয়ার যে পরিবেশ তৈরি হয়েছে তাতে সাধারণ বাড়ির প্রকৃত মেধাসম্পন্ন ছেলেমেয়েরা প্রতিযোগিতার ধারে-কাছে যেতে পারবে না। এভাবে শিক্ষার গুণগত মান ক্রমশ নিচের দিকে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কেবল ডিগ্রী পাক, কিন্তু বিচার, বুদ্ধি, বিবেক, শিরদাঁড়া সোজা করা মনুষ্যত্ব সৃষ্টির জায়গাটা যেন তৈরি না হয়। বাইরে থেকে শিক্ষার ঠাটবাটটি বজায় রাখা হচ্ছে আর ভেতরটাকে সুকৌশলে পুরোপুরি অন্তঃসারশূন্য করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে শিক্ষিত আর অশিক্ষিতর মধ্যে চেতনাগত ফারাকটা ক্রমশ কমছে!
বিখ্যাত সাহিত্যিক টলস্টয় বলেছিলেন “জনগনের অজ্ঞতাই সরকারের শক্তির প্রধান উৎস। সরকারও এটা জানে বলেই সে সর্বদাই যথার্থ শিক্ষা বিস্তারের বিরোধিতা করে। আজ এই সত্যটা বুঝতে হবে।সরকার অজ্ঞতার অন্ধকারও সৃষ্টি করবে, আবার একই সাথে জনগনের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার ঘটাতে সচেষ্ট এমন ভাব দেখাবে — এটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।” তাঁর এই কথাটা আজও বারবার মনে পড়ে।
মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার বিষয় বা সিলেবাস একসময় শিক্ষাজগতের দিকপালগণ তৈরি করেছিলেন। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে বলা হয় সমস্ত শিক্ষার ভিত। একটি বৃক্ষের প্রধান কান্ড কিছুটা উঠে যাওয়ার পর শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়। এই প্রধান কাণ্ডটি দুর্বল হলে তার উপর অন্যান্য শাখা প্রশাখার ভার সে বহন করতে পারে না। শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা হল প্রধান কাণ্ডের মতো। এই সামগ্রিক শিক্ষা গ্রহণের পরই একজন শিক্ষার্থী বেছে নেয় তার পছন্দের দিকগুলি। তার আগেই যদি আমরা সেই প্রধান কাণ্ডটির উপর আঘাত করি তাহলে শিক্ষার ভিতটাও দুর্বল হয়।
এমনিতেই আমাদের রাজ্যে মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে ৩৪ নম্বর পেয়ে পাশ করার পরিবর্তে বর্তমানে ২৫ নম্বর পেলেই পাস করিয়ে দেওয়ার রীতি চালু হয়ে গিয়েছে। তার উপর সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন বা মাল্টিপল চয়েস-এর আধিক্য চোখে পড়ার মতো। বিদ্যালয় থেকে ১০ নম্বর উপরি পাওয়া তো রয়েছেই। এভাবে যখন শিক্ষার গুণগত মান ক্রমাগত কমছে তখন আবার যদি সাতটি বিষয়ের পরিবর্তে পাঁচটি বিষয়ে ২৫ নম্বর করে পেলেই পাস করিয়ে দেওয়ার সস্তা সুযোগ চালু করা হয় তাহলে শিক্ষার মূল্য ছিটেফোঁটাও থাকবে বলে মনে হয় না।
শিক্ষার বুনিয়াদ তৈরি হয় প্রাথমিক শিক্ষার মধ্য দিয়ে। আমাদের রাজ্যে সবচেয়ে অবহেলিত এই প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা। যতদিন না সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হবে ততদিন তার করুণ পরিণতি পরবর্তী শিক্ষাস্তরে পড়তে বাধ্য। সরকারি উদ্যোগে ব্যাপকভাবে শিক্ষা সংস্কার যেমন জরুরী তেমনি এ বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দায়িত্ব কোনো অংশে কম নয়।
এটা তো ঠিক, শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা সবাই কাঙ্খিত মান অর্জন করে সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হবে। এটাই কাম্য। তা কি পাশ নম্বর কমিয়ে দেওয়া বা দুটি বিষয়কে কার্যত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিলুপ্ত করার মধ্য দিয়েই কাম্য? বরং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যার ফলে প্রতিটি শিক্ষার্থী তার কাঙ্খিত মান সহজেই অর্জন করতে পারবে। জোর করে পাস করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রশ্নই আসবেনা। প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরেই যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও৷