বন্ধ্যা নারীর আট হাজার সন্তান, পদ্ম সম্মান পেলেন ১০৬ বছরের থিম্মাক্কা

শাম্মী হুদা: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা চিরদিন পিছনের সারিতেই থেকে গেলেন। বাহ্যিকভাবে তাঁদের এগিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করলেও বাস্তবে সাফল্যের ক্ষীর যায় পুরুষের পেটেই। আর সেই নারী যদি বন্ধ্যা হন, তাহলে তো কথাই নেই। সম্মানটুকু দূরে যাক বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ মেলে না, তবু ভারতীয় নারী তো তাই হার মানতে শেখেননি। সেই হার না মানা মনোভাবই

বন্ধ্যা নারীর আট হাজার সন্তান, পদ্ম সম্মান পেলেন ১০৬ বছরের থিম্মাক্কা

শাম্মী হুদা: পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা চিরদিন পিছনের সারিতেই থেকে গেলেন। বাহ্যিকভাবে তাঁদের এগিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করলেও বাস্তবে সাফল্যের ক্ষীর যায় পুরুষের পেটেই। আর সেই নারী যদি বন্ধ্যা হন, তাহলে তো কথাই নেই। সম্মানটুকু দূরে যাক বেঁচে থাকার ন্যূনতম সুযোগ মেলে না, তবু ভারতীয় নারী তো তাই হার মানতে শেখেননি। সেই হার না মানা মনোভাবই ১০৬ বছরের থিম্মাক্কাকে পদ্মশ্রী সম্মানে এনে দিল। কে এই থিম্মাক্কা, কী করেছেন তিনি? চলুন একবার তাঁর আটপৌঢ়ে সংসারে উঁকি মেরে দেখি।

মেয়েদের স্বাধীনতায় হাজার বাধা, আর সেই মেয়ে বাড়ির বধূ হলে বাধাও হয়ে ওঠে পাহাড় প্রমাণ। কর্ণাটকের গুব্বি তালুকের বাসিন্দা বেকাল চিক্কাইয়া গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী থিম্মাক্কা। বিয়ের অল্পদিন পরেই গোটা পরিবার নববধূকে অপছন্দের তালিকায় ফেলে দেয়, অপরাধ মা হতে পারেনি বাড়ির বউ। এরপর একটা দুটো করে ২৫টা বসন্ত কেটেছে, থিম্মাক্কার জীবনে বসন্ত আসেনি। অবহেলা অপমানে কেটেছে প্রতিটা মুহূর্ত, একটা সময় পরিবারের পাশাপাশি গ্রামের লোকজনও দুর্ব্যবহার করতে শুরু করে। ঘাটে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। বাজার হাট শিকেয় ওঠে। সবাই মন থেকে তাঁকে দূর করে দিলেও স্বামী চিক্কাইয়া স্ত্রীকে আগলে রেখেছেন বরাবরের মতো। একটা সময় বেঁচে থাকাটাই অসহ্য হয়ে ওঠে। গোটা পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে এক কাপড়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান চিক্কাইয়া। এবার তাঁদের প্রতি হওয়া অন্যায় আচরণের জবাব দিতে শুরু করেন ওই দম্পতি।

বন্ধ্যা নারীর আট হাজার সন্তান, পদ্ম সম্মান পেলেন ১০৬ বছরের থিম্মাক্কানিজের হাতে গাছ লাগাতে শুরু করেন থিম্মাক্কা, বটের চারা বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে প্রথমে কয়েকটি বটের চারা লাগান তিনি। পরম যত্নে শুরু হয় লালন পালন, কে বলে তিনি মা হতে পারেননি। তাঁর যত্নেই এক বছরের মধ্যে বটের ছায়া শাখাপল্লবে বিস্তার করে। গাছএকটু বড় হতেই কাজ ছেড়েদেন চিক্কাইয়া। সেই সময় সারা দিন গাছের লালন পালন করতেন, আর থিম্মাকা জনমজুরি করে পেটের খোরাক জোগাড় করে আনতেন। তারপর সন্ধ্যা নামলে বাড়ি ফিরে স্বামীর সঙ্গে গাছের পরিচর্জায় মেতে উঠতেন। যার একদিন অপমানে ভরিয়ে দিয়েছিল ওই গৃহবধূর চলার পথ তারাই তাঁকে গাছেদের সারি নামে ডাকতে থাকে।

তিন বছরের মাথায় ৪৫টি সন্তান নিয়ে ভরা সংসার হল থিম্মাক্কার। গাছেদের মা হয়ে উঠলেন তিনি।এরমধ্যে ৯১ সালে চলে গেলেন চিক্কাইয়া,তারপর থেকে একা একাই সন্তানদের পালন করে চলেছেন থিম্মাক্কা। ৯৬ সালে তিনি তাঁর মহতী কাজের জন্য জাতীয় নাগরিকের সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে। ২৫ বছরের দাম্পত্য অতীত হলেও থিম্মাক্কার নিজের গ্রাম হুলিকাল থেকে কুদুর অবধি মোট ২৮৪টি বটগাছের চারা লাগিয়ে বড় করেন তিনি। প্রায় চার কিলোমিটার পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াময় সুবিশাল গাছগুলি থিম্মাক্কার ভালোবাসারই নিদর্শন, বলেন পথচারীরাও। তাঁর কথা জানতে পেরে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থাও তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে থিম্মাক্কার গাছগুলির দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে কর্নাটক সরকার নিজেই।যদিও নিজের সন্তানদের পালনের জন্য কারোর সহযোগিতা চাননি বৃদ্ধা থিম্মাক্কা।

একটি একটি করে আট হাজার সন্তানের মা আজ থিম্মাক্কা, কোনও বাধাই তাঁর অপত্য স্নেহকে বাঁধতে পারেনি। ১০৬টি বসন্ত পেরিয়েও আট হাজার সন্তানের দেখভালের দায়ভার ছাড়তে পারেননি। তাঁর কোলে এখন প্রায় আট হাজার সন্তান বড় হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের কারণেই এবার পদ্ম সম্মানের পালক জুড়ল থিম্মাক্কার মুকুটে। তিনি তো সর্বজনীন মা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

6 − 1 =