সিদ্ধার্থ বোস: অন্ধকার রাত, তার ওপর প্রবল বৃষ্টি পড়ছে। দুই বন্ধু সেই গভীর রাতে গেলেন গহন জঙ্গলে। দেখতে পেলেন জঙ্গলের ভিতর একটা আলো দেখা যাচ্ছে। আলোটা উজ্জ্বল কিন্তু তীব্র নয়, তার রং নীলাভ। কিছুটা এগিয়ে গেলেন তাঁরা, দেখতে পেলেন একটা গাছের গুঁড়ি থেকে ওই আলো নির্গত হচ্ছে। কিছুদিন পর একটা লেখা প্রকাশ হল- ‘পচা গাছপালার আশ্চর্য আলো বিকিরণ করার ক্ষমতা’ শিরোনামে। সেদিন ওই গাছের গুঁড়ির কিছুটা অংশ কেটে নিয়ে এসে গবেষণা করেছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, দেখেছিলেন পচে যাওয়া গাছ আলো বিকিরণ করতে পারে। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় এই লেখা পড়েছিলেন ভারতীয় বিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ডেকে পাঠান গোপালকে। নিযুক্ত করেন তাঁর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে গবেষণার স্কেচ ও যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজে। যাত্রা শুরু হয় গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যের।
আরও পড়ুন: রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল প্রকাশের দিন ঘোষণা শিক্ষামন্ত্রীর
প্রথাগত বিজ্ঞানশিক্ষা ছিল না অ-বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্রের। মৃত্যুর তিন মাস আগে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছিল, কিন্তু তাঁর অনেক অনেক আগেই বিভিন্ন আবিষ্কার করে ফেলেছিলেন। স্মৃতির অতলে প্রায় বিস্মৃত হয়েছেন এই বাঙালি কী ও পতঙ্গবিদ।
১৮৯৫ সালের ১ আগস্ট অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুরের লনসি গ্রামের এক অভাবী পরিবারে জন্ম হয় গোপালচন্দ্রের। তাঁর বয়স যখন পাঁচ তখন বাবা অম্বিকাচরণ ভট্টাচার্য মারা যান। মা শশিমুখী দেবী ও চার ভাই-বোনের দায়িত্ব এসে বর্তায় বড় ভাই গোপালের ওপর। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে আইএ নিয়ে ভর্তি হলেও অর্থসংকটে মাঝপথে পড়াশোনা বন্ধ হয় তাঁর। স্থানীয় এক স্কুলে শিক্ষক হিসাবে কাজ করতে শুরু করেন। এই স্কুলেই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর লেখা নিয়ে একটি পত্রিকা ছাপাতেন তিনি। প্রকৃতির হাতছানিতে স্কুলের বাগানেই ফল ও ফুলের সংকরায়ন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
আরও পড়ুন: JEE, NEET স্থগিতের দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের ঝড় পড়ুয়াদের
বসু বিজ্ঞান মন্দিরে, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর জায়গা করে নিয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র গোপালকে পারস্পেক্টিভ অঙ্কন প্রশিক্ষণের জন্য গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ভর্তি করেন। সেখানে তিনি নগেন্দ্রনাথ দাসের সঙ্গে ফটোগ্রাফি নিয়ে কাজ করা শুরু করেন। এরপর বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ফিরে এসে মাইক্রোস্কোপ নিয়ে গবেষণার কাজে যুক্ত হন জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে। সেই সুবাদে বিভিন্ন প্রোটোজোয়ার আকার আকৃতি দেখে তিনি তাদের নিয়ে গবেষণা করার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েন। ফলে উদ্ভিদ থেকে শুরু করলেও এসে পড়েন প্রাণিজগতে। একদিন একটি জলায় মাকড়সাকে মাছ শিকার করতে দেখে তার ছবি তুললেন গোপাল। সেই ছবি দেখে জগদীশবাবু তাঁকে একটি থিসিস লিখতে বললেন। বসু বিজ্ঞান মন্দিরের মুখপত্র ‘ট্রানজাকশন’-এ ছাপা এটিই প্রথম থিসিস। এরপর তিনি নানারকম প্রাণীদের নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। ১৯৪০ সালে একটি জারের মধ্যে বোলতা নিয়ে পরীক্ষা করে তিনি দেখেন কীভাবে তারা ছোট ছোট পাথর দিয়ে ঘরের দরজা তৈরি করে। ‘ইয়ারউইগ’ নামক এক কেন্নো প্রজাতির অমেরুদণ্ডী প্রাণী দ্রুত মাটির বল তৈরি করে শত্রু পক্ষের দিকে ছুড়ে প্রতিঘাত করে, প্রজননের সময়কালে।
১৯৫১ সালে প্যারিসের বিজ্ঞান সভায় আমন্ত্রণ করা হয়েছিল গোপালচন্দ্রকে, কিন্তু সেখানে তাঁকে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের কাছে অপমানিত হতে হয়, কারণ প্রথাগত শিক্ষার সার্টিফিকেট ছিল না তাঁর। ১৯৬৫ সালে অবসর নেন গোপালচন্দ্র। ১৯৮১ সালে তাঁর মৃত্যুর ঠিক তিন মাস আগে তাঁকে বিজ্ঞানে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। কর্মজীবনে প্রায় হাজারেরও বেশি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ লিখেছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর সঙ্গে ‘বাঙালি বিজ্ঞান পরিষদ সমিতি’ গঠন করেন। এছাড়াও বিজ্ঞান বিষয়ে একাধিক বইও তিনি রচনা করেছেন। ‘বাংলার কীটপতঙ্গ’ বইয়ের জন্য রবীন্দ্র পুরষ্কার (১৯৭৫) এবং আনন্দ পুরষ্কার (১৯৬৮) পান। পেয়েছেন ভারত সরকারের তরফ থেকে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান। ১৯৮১ সালের ৮ এপ্রিল বিজ্ঞানী গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য পরলোক গমন করেন। আজ তাঁর ১২৫তম জন্মদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য।