Aajbikel

পুজো-পাঠ ২০২০: ‘গুঞ্জন’ কলমে ভার্গবী

 | 
পুজো-পাঠ ২০২০: ‘গুঞ্জন’ কলমে ভার্গবী
 ভার্গবী

 [এক]

বালিশে মুখ গুঁজে গুমরে গুমরে কাঁদছে গুঞ্জন। কত চেষ্টা করছে, তবু গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসা কান্নাকে থামাতে পারছে না। কান্নাও আশ্রয় নিয়েছে বালিশে। কিন্তু গুঞ্জনের আজ নিজেকে বড়ো আশ্রয়হীন মনে হয়, অথচ ও কক্ষনো প্রকাশ করতে পারবে না ওর আশ্রয়হীনতাকে। কর্ণ যেমন অনেক আভিমান নিয়ে বলেছিল, “সূতপুত্র আমি, রাধা মোর মাতা” ঠিক সেভাবেই গুঞ্জন অনেক অভিমান্‌, ভালবাসা চেপে রেখে বলে, “মা, আমি তোমার মেয়ে। অপর্ণা বোসের মেয়ে। আমার বাবা শুভজিত বোস।” গুঞ্জনের কান্না একান্ত ভাবেই তার একার। প্রায়ই গুঞ্জন এভাবে কেঁদে ওঠে। ওই লোকটার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে ভাবে ঠিকই, কিন্তু সামনে গেলেই সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়।

এই তো আজই বিকেলের ঘটনা, তাঁর মুখের উপর উত্তর দিয়ে বেড়িয়ে গিয়েছিলো গুঞ্জন। দোষের মধ্যে দোষ লোকটা বলেছিল, “আমি এলাম, আর তুমি বেড়িয়ে যাচ্ছ?”

গুঞ্জন খুব ধীর অথচ খুব রূঢ় ভাবে কথা শুনিয়ে দিল। বলল, “আপনার তো প্রচুর টাকা। টাকা গুলো খরচ করার দরকার তাই আপনি বার বার আসেন। কিন্তু আমি তো আমার সময় আপনার কাছে বিক্রি করতে নারাজ। আচ্ছা চলি…।”

মেয়ের কথা শুনে অপর্ণা থতমত খেয়ে গেল। কোনমতে জিজ্ঞেস করল, “কোথায় যাচ্ছ?” যেতে যেতে, রুদ্ধ কণ্ঠস্বর কে ঢেকে গলা শক্ত করে গুঞ্জন বলে গেল, “বন্ধুর বাড়ী।”

ও চলে যাবার পর একরাশ শীতল নিস্তব্ধতা চেপে ধরল ঘরটাকে। অপর্ণা চা করতে চলে গেলো সৌরভ কে বসতে বলে। রান্নাঘরে গিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো অপর্ণার বুক থেকে।‘টিং টং’....... বেল টা বেজে উঠতেই অপর্ণা রান্নাঘর থেকে চেঁচাল, “আসি…”

এটা শুভজিতের ফেরার সময়। সৌরভ বাইরের ঘরে ছিল, বললো, “আমি খুলছি। তুমি একেবারে চা নিয়ে এসো।”

                            [দুই]

দরজা খুলতেই দরাজ মনের শুভজিত দরাজ গলায় চেঁচাল, “আরে… সৌরভ যে, কতক্ষণ?”

“এই কিছুক্ষন।” ধীর ভাবে উত্তর দিল সৌরভ। শুভজিত জিজ্ঞেস করল্‌, “মিঠি কি ভেতরে?”  উত্তরের অপেক্ষা না করেই চেঁচাল, “মিঠি ও মিঠি…”

সৌরভ বলল, “তোমার কন্যা বন্ধুর বাড়ী গেছে।” চা নিয়ে এসময় প্রবেশ করল অপর্ণা। শুভজিত দরাজ মনের মানুষ। কিন্তু মিঠির ব্যপারে ওকে সংকীর্ণ বললে দোষের হবে না। ওর মিঠি শুধু ওরই। সে শুধু ওই মিঠিকেই ভালবাসবে।

ইদানিং শুভজিত নিজের একাকীত্বে হারিয়ে যায় কখনো সখনো। হঠাৎ চুপ করে যাওয়া, নিজের আজান্তেই কোনও ভাবনায় ডুবে যাওয়া, এসব রোগ ছটফটে প্রাণবন্ত শুভজিতের ছিল না। আফিসে দাপুটে, সমাজে মিশুকে, পিতৃস্নেহে আর পত্নীপ্রেমে ভরপুর মজাদার মানুষ শুভজিত আগে কখনও এরকম নিজের কাছ থেকে নিজে হারিয়ে যেত না। কিন্তু এখন?...

১৭ বছর পর অফিসে ওর দরজা নক করে সৌরভ যেদিন ওর কেবিনে ঢুকেছিল সেদিন শুভজিত প্রথমটায় নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছিল না। ওর মাথার উপর এক পাহাড় পাথরের ভার নেমে এসেছিলো। পায়ের নীচে চোরাবালি, বুকে ভীষণ সমুদ্রের গর্জন। গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল তার। কোনোমতে অস্ফুটে শুভজিত জিজ্ঞেস করেছিল, “তুমি …? এখানে…?” শীতল কণ্ঠে সৌরভ বলেছিল, “মেয়েটা আমাকে টানছে।” আঁতকে উঠেছিল শুভজিত, “মিঠিকে ছাড়া আমরা বাঁচবো না সৌরভ।” সৌরভ আগের থেকে আরও ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিল, “আমিও যে ওর জন্য কেঁদে মরি।” শুভজিত এক বিশাল অস্পষ্ট শূন্যতায় হারিয়ে যাচ্ছিল, তলিয়ে যাচ্ছিল, কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। সৌরভ বুঝতে পারে শুভজিতের কষ্টটা, মৃদু হেসে বলেছিল, “না‌, ভয় পেও না। আমি ওকে তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে আসিনি। শুধু ওকে একটু দেখতে চাই। একবার। প্লিজ না করো না।” একদমে কথাগুলো বলার পর করুন চোখ দুটি নিয়ে শুভজিতের দিকে তাকিয়ে থাকল। বাবা শুভজিত আরেক বাবার মনের অবস্থা টা উপলব্ধি করে, না করতে পারল না।

প্রথমটাতে শুভজিতের বন্ধু বলে মিঠির সঙ্গে সৌরভের আলাপ হয়। সৌরভ একবার মিঠির আকর্ষণ উপলব্ধি করে বারবার ফিরে ফিরে আসে। এরকম আসা, মিঠির জন্য দামী উপহার আনা, মিঠির অস্বস্তির কারন হলেও বাবার বন্ধু বলেই মিঠি কিছু বলতো না। হঠাৎ একদিন মিঠিকে কাছে ডেকে সৌরভ বলল, “ মা রে তুই ভ্রমরের গুঞ্জন।” ওঁর আবেগ, ওঁর কথা মিঠি বিন্দুমাত্র বোঝেনি সেদিন, কিন্তু যারা বুঝল, তাদের ভেতরটা এক আজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। মিঠি আবাক হয়ে বলেছিল, “ঠিক বুঝতে পারলাম না কাকু!” সৌরভ বলল, “তোকে যদি গুঞ্জন বলে ডাকি সাড়া দিবি?” মিঠি বাবা মার দিকে তাকায়। শুভজিত তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ সাড়া দেবে। কাল তোর কি পরীক্ষা বললি মিঠি, পড়তে বসবি না?” মিঠ, “ওরে বাবা গো।” বলে নিজের ঘরে ছোটে।

এই ঘটনার পরই অপর্ণা মিঠিকে সব জানানো উচিৎ বলে মনে করেছিল। শুভজিত আজ ভাবে না জানালেই বা কি হতো? সৌরভ তো বলেই ছিল যে কিচ্ছুটি বলবে না সে। কিন্তু যদি বলে ফেলে, ভয় হয়। অন্য কেউ কেন বলবে? ভালবাসারও একটা ভয় আছে, বুঝতে পারে শুভজিত, সেটা হারানোর ভয়। সে ভয় ভীষণ ভয়ঙ্কর। গিলে খেতে আসে প্রতিমুহূর্তে, না মরতে দেয়, না বাঁচতে।

                           [তিন]

এই একটু আগেই শুভজিতের সঙ্গে মিঠি বেড়িয়ে গেল। শুভজিত মিঠিকে কলেজে ছেড়ে দিয়ে অফিসে চলে যায়। এরপর থেকে অপর্ণার সময়টা নিঃশব্দে, নীরবে কেটে যায় সংসারের নিত্য কাজে, কোনদিন মিঠি আর শুভজিতের পছন্দের খাবার বানাতে বানাতে। কোনদিন বা স্মৃতি ঘাঁটতে বেলা বয়ে যেত, সাথে থাকতো ওদের ফেরার অপেক্ষা।

অপর্ণার মনে পড়ে যায় সেই দিনটার কথা, যেদিন ও প্রথম বার মিঠিকে নিজের করে পেয়েছিল। কি নরম, কি মায়া ওই অতটুকু প্রানে। হঠাৎ শিউরে ওঠে অপর্ণা। মিঠি কি অপর্ণার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। অপর্ণার তো মিঠি ছাড়া আর কোনও্ অবলম্বন নেই। নাঃ, আর ভাবতে পারছে না অপর্ণা। কী ভীষণ একা লাগে তার। ডুকরে কেঁদে ওঠে অপর্ণা। কেন সে মিঠিকে সব বলে দিলো, শুভজিতই বা বাধা দেয়নি কেন? তারও কি সেদিন বুদ্ধি হারিয়ে গিয়েছিল। শুভজিত না করলে তো অপর্ণা বলতো না। ওইটুকু তো মেয়ে আমার, কত কষ্ট পেয়েছে। আরও বিস্তর কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে। সব চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে অপর্ণার। কিচ্ছু ভাবতে পারছে না সে। আজ ঘরের কাজেও মন নেই তার, ভাবনা গুলো তাকে কাজ গুছোতেও দিচ্ছিল না। চান সেরে ভিজে চুল এলিয়ে সোফায় বসলো অপর্ণা। হঠাৎ অসময়ে দুপুর সাড়ে তিনটে নাগাদ দারজার ঘণ্টিটা বেজে উঠে আনমনা অপর্ণাকে চমকে দেয়। অপর্ণা ভেতর থেকে সাড়া দেয়, “কে?” উত্তর আসে, “আমি।” দ্রুত পায়ে অপর্ণা বলতে বলতে দরজার দিকে এগোয়, “ও মিঠি, দাঁড়া খুলছি।” দরজা খুলেই জিজ্ঞেস করল, “বললি সাড়ে তিনটে তে লাস্ট ক্লাস? শরীর ঠিক আছে তো?” মিঠি বলে, “তিন তিনজন ম্যাডাম আজ আসেননি। জল দাও তো মা,”

“দাঁড়া, একটু বোস বাবা, নাহলে নর্মাল জল খা, ঠাণ্ডা জল এখুনি দেব না।” মিঠি বিরক্তি সূচক একটা উফফ বলে মাকে বলে, “তুমি কি শুয়েছিলে?”

“না, রে ভাবছিলাম।” হঠাৎ এমন একটা উত্তর দিয়েই সামলায় অপর্ণা, যা মেয়ে ঠিক ধরবে। তাই তাড়াতাড়ি বলে, “এবার খেতে যাবো ভাবছিলাম।”

“ এখনও খাওনি মা, আর কি এড়িয়ে যাচ্ছ? বল কি ভাবছিলে?”

“তুই ভাত খাবি তো?”

“বলবে না তাইতো” বলেই মিঠি ব্যাগ টা নিয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।

“উফফ, অমনি মেয়ের রাগ হয়ে গেল, শিগগির চেঞ্জ করে আয়, খিদে পেয়েছে।” একটু পরেই মিঠি ফিরে এসে বলল, “অসহ্য লোকটা আজ আবার আসবে। তাই না? একটা আবান্তর লোককে নিয়ে এত ভাবার কি আছে কে জানে?” মিঠির গলায় ছিল তীব্র ঝাঁজ।

“না, মিঠি না, ওভাবে বলে না। উনি তোমার বাবা।”

“আমার বাবা শুভজিত বোস।” মেয়ের উত্তরে কি রকম আনন্দ হয় অপর্ণার। মায়া, স্নে্‌হ, ভালবাসা নিয়ে তাকায় মেয়ের দিকে, কত বড়ো হয়ে গেছে মিঠি। খুশী টা মিলিয়ে যায় মুহূর্তে, সত্যি মিঠি বড়ো হয়ে গেছে, এখন বোধহয় বুঝতে পারে কোন কথা কাকে আনন্দ দেয়, আশ্বস্ত্ব করে। মিঠি মায়ের এ ভাবনা টের পায় না। নিজে হাতে ভাত বেড়ে মাকে খেতে বসায়। অপর্ণার চোখ রাঙা হয়ে ওঠে। মিঠি তখন পিছন ফিরে ফ্রিজ থেকে নিজের জন্য ফল বেড় করছিল, গুন গুন সুর তুলে হয়তো বা গুঞ্জন নাম কে ভুলে গিয়েই। টেবিলে ফল গুলো রাখতে গিয়ে মায়ের দিকে চোখ পড়ল তার, তাড়াতাড়ি এসে মা কে জড়িয়ে ধরল সে। ধীর, শান্ত গলায় বলল, “তুমি কি আমাকে হারাবার ভয় পাও মা?” অপর্ণা ভীষণ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল মিঠিকে। মিঠির লাগছিল, তবু কিছু বলল না।

                            [চার]

মিঠি অনেকটা শুভজিতের মত। হাসিখুসি, ছটফটে। তখন মিঠি সদ্য কৈশোর থেকে যৌবনে পা দিচ্ছে। বাবা মার আদুরে মিঠির কাছে ঘটনাটা এলো একটা দুর্ঘটনার মত। শুভজিত রোজকার মতো সেদিনও সকালে মিঠিকে ঘুম থেকে ডাকতে এলো। তবে একটু বেশী সকালেই এসেছে শুভজিত। মেয়ে কে ডেকে বলল, “চল মর্নিংওয়াকে যাই।” মিঠি চোখে একরাশ ঘুম মেখেই বলল, “না বাবা আমি নেই।” বলেই পাশ ফিরে চোখ বুজিয়ে ঘুমের ভান করল। শুভজিত ওর কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুই আমার, মিঠি তুই আমার।” ইতিমধ্যে অপর্ণাও ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে, “দেখ, কি নিস্পাপ, সরল মুখটা। কি ভাবে বলবে ওকে? ও শুনলে যে বড্ড কষ্ট পাবে গো।” মিঠি মিষ্টি হাসিটি হেসে বলে, “আমি কিন্তু ঘুমাইনি। কি বলবে মা? সব শুনে ফেলেছি। বলে ফেলো, বলে ফেলো। কষ্ট নেহি পায়েগা।” শুভজিত দু হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে কাঁপা গলায় বল্ল, “না, না। কিচ্ছু না। শুধু জান তুই আমার।” মিঠি তাড়াতাড়ি উঠে বসে। জোর করে বাবার মুখের আড়াল সরিয়ে দিয়ে ভীষণ আবাক হয়ে অস্ফুটে বলে, “বাবা…তুমি কাঁদছ!” অপর্ণা এসে মিঠির পাশে বসলো, “তুমি বাবা তো, পারবে না। আমি বলছি।” তার গলায় ছিল কঠোর সত্য স্বীকারের ঔদ্ধত্য আর চাপা কষ্ট। মিঠি আবাক হয় আরও। মায়ের এ রূপ সে কক্ষনো দেখেনি। সকাল বেলা হঠাৎ কি শুরু হয়েছে? সে তো কিছুই বুঝছে না। শুধু অনুভব করছে একটা ভয়ঙ্কর কিছু সে শুনতে ছলেছে। অপর্ণা দৄঢ় গলায় বলতে শুরু করল, “মিঠি তুমি বড়ো হচ্ছ। মন টাকে শক্ত কর।” মা একবার বাবার দিকে তাকালো, বাবা মাটির দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিচ্ছু বুঝতে পারছে না মিঠি। ভ্রু কুঞ্চিত করে অনেক জিজ্ঞাসা নিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। মা বলে চলেছে, “শোনো মন দিয়ে মিঠি। তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে তুমি আমাদের কাছে থাকতে চাও না সৌরভদার কাছে থাকবে?” অপর্ণার কথা বলার ধরন কি মারাত্মক। চমকে ওঠে শুভজিত। মিঠিও অধৈ্র্য্য্ হয়ে ওঠে, “সৌরভ কাকু!...মতামত!...কি বলছ তুমি?...আমি!...

“এখন কোন কথা বোলনা। মিঠি আগে সব টা শোন।” মিঠি চুপ করে গেল। অপর্ণাও একটু সময় চুপ করে থাকল। তারপর আবার বলতে শুরু করল। “সৌরভদা তোমার বাবা। তুমি আমাদের  মেয়ে। কিন্তু তোমার মায়ের নাম ভ্রমর। তোমার বাবা মা একে অপরকে ভালবেসে সব ছেড়েছিলেন। বাড়ী, সম্পত্তি, তাদের বাবা মা, সব কিছু ছেড়ে এসেছিল ওরা। সৌরভদা ব্যবসা সুত্রে তোমার বাবার অফিসে যাতায়াত করতেন, সেখান থেকেই বন্ধুত্ব। সব ছেড়ে আসা সৌরভদাকে দুঃখ পেতে দেয়নি মাদ্রাজি মেয়ে ভ্রমর। এর মধ্যে তোমার আসার খবর ওদেরকে ভাসিয়েছিল সুখের সাগরে। কিন্তু সুখ ওদের সইল না। তুমি পৃথিবী তে আসার ক্ষণটি তে তোমার মা বিদায় নিলেন। সৌরভদা সেদিন শোকে দুঃখে পাগল হয়ে গেছিল। তোমাকে মেনে নিতে পারছিল না। সেই মুহূর্তে তোমার ওই ছোট্ট হাত টা ছুঁয়ে আমি পরশমণি পেলাম সোনা। তুমি আমায় মা হয়ে উঠতে দিলে। আমি মা হলাম। তুমি না এলে আমার জীবনে এ অনুভুতি কোনও দিন আসতো না।” একটানা কথা গুলো বলে অপর্ণা থামল। সারা ঘর টা জুড়ে যেন লাশকাটা ঘরের নিস্তব্ধতা, বীভৎস, শীতল, স্যাঁতস্যাঁতে একটা অনুভুতি।

একটু পরে অপর্ণা আবার শুরু করে “আজ ১৮ বছর পর সৌরভদা তোমার কাছে ফিরে ফিরে আসে বার বার। সময়ের সাথে তাঁর শোক এখন কমে এসেছে। এখন সে বোঝে তোমার সাথে ভ্র্রমরের যোগটা নাড়ীর যোগ। তার স্নেহ এখন উত্তাল হয়ে উঠেছে শুধু আছড়ে পরার বাসনায়। অন্য কোনও ভাবে এ সত্য তুমি জান আমরা চাইনি। তুমি বড় হচ্ছ। তুমি স্বাধীন। কোন আইন কোন কিছুই রক্তের সম্পর্ক কে অস্বীকার করতে পারে না। মনে রেখো ভালবাসা ছাড়া সম্পর্কের আর কোন দায় হয় না। শেষ কথা গুলো বলে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না অপর্ণা। শুভজিতের কোলে মাথা রেখে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। মিঠির ঠোঁটটা কেঁপে উঠলো। গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোল না। সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল। ঘরটাকে জড়িয়ে ধরল একরাশ নিস্তব্ধ ব্যথা আর জমে থাকল অনেক কান্না ঘরের আনাচে কানাচে।

অনেক টা সময় এভাবে কেটে যাবার পর মিঠি ধীরে ধীরে অতিকষ্টে বলল, “আমি তোমাদের মেয়ে। এই পরিচয়ে ধন্য।” মিঠি কে জড়িয়ে নিয়ে আরও কতক্ষন যে ওরা বসেছিল সে হিসেব কেউ রাখেনি।

                           [পাঁচ]                             

মাঝে মাঝে মিঠি হারিয়ে যায় এক ভাবনার জগতে। ওর জীবন ভরে ছিল হসিগান, ছন্দ, আনন্দে। কৈশোরের দোলায় বেণী দুলিয়ে হাত ঘুরিয়ে নেচে উঠেছিল সেও। কিন্তু যৌবনের ঢেউ আর দশ জনের মত তাকে দোলায়নি। নিজেকে নিজের কাছে ভারী লাগে তার। অদ্ভুত মানুষের মন। মানিয়ে চলা শধু বেঁচে থাকার জন্য না কি বাঁচিয়ে রাখার জন্য। দয়া না করলে ওর অস্তিত্ব থাকতো?

মা রান্নাঘরে কি যেন করছিলো, “মিঠি আওয়াজ নেই কেন রে, ঘুমচ্ছিস না পড়ছিস?” গলাটা যতটা স্বাভাবিক রাখা যায় রেখেই মিঠি উত্তর দিল, “উফফফফফ, পড়ছি তো। মনে মনে।” সামনে নোটের খাতা খুলে রেখে নিজেকে পড়ছিল মিঠি। আবার ডুবল সে নিজের ভাবনায়। সে দয়ার বস্তু। ঘৃণা! সৌরভ তো তাকে ঘৃণা করতো। সে ঘৃণার বস্তু। নিজেকেই অসহ্য লাগে মিঠির। লোকটা কেন এলো? তার মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভাসা পানসি টা কে ঝড়ের মতো এসে ওলট পালট করে দিল।

অপর্ণা রান্না ঘরের কাজ শেষ করে টিভি টা খুলে বসল। মিঠি্র পছন্দের একটা অনুস্ঠান হচ্ছে দেখে ওকে ডাকল। অনেক কিছু অনেক সময় ভাল না লাগলেও, ভাল লাগাতে হয়। তাই একাকীত্ব ছেড়ে মায়ের কাছে বসলো মিঠি। ইতিমধ্যে টেলিফোন টা ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠতেই মিঠিই গিয়ে ধরল।

“হ্যালো”

“ওঃ গুঞ্জন”

“ওঃ আপনি ধরুন, মা কে দিচ্ছি”

“তুমিই শোন না”

“বললাম তো, ধরুন মা কে দিচ্ছি” ঝাঁঝিয়ে ওঠে গুঞ্জন। মেয়ের কথা বলার ধরন দেখে ততক্ষনে উঠে এসেছে অপর্ণা, “হ্যালো”

ওপার থেকে সৌরভ বলে, “অপর্ণা, আমি আজ যাবো না”

“ওমা কেন? কি হল?

ভেতরের ঘরে গিয়ে মিঠি প্যরালাল লাইন টা কানে ধরে, বাবার গলার আওয়াজ টা শুনবে বলে।

ওপার থেকে তার বাবা বলে, “আসলে একটু জ্বর এসেছে”

“সেকি? সিজিন চেঞ্জের সময়। চারিদিকে হচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়েছেন?”

“ও সামান্য জ্বর।”

“না না ফেলে রাখা ঠিক নয়। আপনি তো পার্ক প্লাজা তেই উঠেছেন?”

“হ্যাঁ, সকালে এসেছি”

“জ্বর টা কবে থেকে”

“দু তিন দিন ধরেই আসছে যাচ্ছে।”

“জ্বর নিয়ে এতটা জার্নি করতে গেলেন কেন?”

“আসলে মেয়েটা… যাক সে কথা। আজ যাবো বলেছিলাম, না গেলে চিন্তা করবে তাই জানিয়ে দিলাম”

“একটা ডাক্তার?...”

“আরে দূর ওত ভেবো না। রাখি।”

মিঠি ফোন টা নামিয়ে রেখে নিজের ঘরে এল। উফফ জ্বর বাঁধিয়েছে। কষ্ট হচ্ছে মনে হয় খুব। নাহলে সে ঠিক আসতো। খুব কান্না পায় মিঠির। “মিঠি দুধ টা নিয়ে যা তো” মায়ের ডাকে  অসমাপ্ত কান্না কে কোনোমতে গিলে ফেলে মিঠি বলে, “আসছি।”

শুভজিত আসতেই অপর্ণা সৌরভের কথাটা ওকে জানাল। শুভজিত বলল, “ও যা লোক ডাক্তার দেখাবে না। আমাদের একবার যাওয়া উচিত।” অপর্ণাও রাজি। বেঁকে বসলো মিঠি, সে যাবে না। ইচ্ছে ছিল না, তা নয়, তবু কি একটা জিনিস বাঁধা দিল। শুভজিত আর অপর্ণাই গেল। যাওয়ার আগে শুভজিত মিঠিকে ভাবতে বলল, “জেনে বুঝে কাউকে আঘাত করার থেকে মানিয়ে নেওয়া ভালো নয় কি?” একথা মিঠি বোঝে। ওরও কষ্ট হয় বাবার সাথে এমন করতে। কিন্ত করতে হয়, কারন শুভজিত আর অপর্ণা কে নিশ্চিন্ত করতে চায় সে, বোঝতে চায় সে একমাত্র তাদেরই।

                        [ছয়]    

অপর্ণা আর শুভজিত সৌরভকে একপ্রকার জোর করেই হোটেলের পাট চুকিয়ে ওদের সাথে যেতে বাধ্য করলো। ওখান থেকে বেড়িয়ে সোজা ডাক্তার দেখিয়ে একেবারে ওদের বাড়িতে নিয়ে এলো সৌরভকে। "তোমরা শুধু শুধু উতলা হলে।” অপর্ণা সঙ্গে সঙ্গে ধমক লাগায়, “এক্কেবারে বাধ্য ছেলের মত চলুন। আর এবার থেকে এসে আমাদের বাড়ীতেই উঠবেন।” রাত প্রায় সাড়ে আটটা, বেলের শব্দে গুঞ্জন এসে দরজা খুলল। “দেখ কাকে নিয়ে এসেছি” সহজাত ভঙ্গিতে ট্যাক্সির ভাড়া দিতে দিতে বলে শুভজিত। “দেখলাম” বলে ভেতরে চলে গেল মিঠি। অপর্ণা আসহায় দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল শুভজিতের দিকে। অবাধ্য দীর্ঘশ্বাসকে চেপে রাখতে না পেরে সৌরভ মিঠির যাওয়ার পথের দিকে চোখ রেখেই ভেতরে এলো।

ঘণ্টা দুয়েক পর মায়ের ডাকে খাওয়ার টেবিলে এলো মিঠি। মিঠি চুপচাপই খাচ্ছিল। সৌরভই জিজ্ঞেস করল, “কি হল, এত চুপচাপ যে।”

“খাওয়ার সময় কথা বলা উচিৎ নয় বলেই তো শুনে এসেছি।” অতি ধীর, শীতল, গলায় উত্তর দিল মিঠি। গুঞ্জনের উত্তরটা দমাতে পারল না সৌরভকে। আবার বলে সে, “কিন্তু বাঙালি মানে আড্ডা প্রিয় জাত, আর খাবার টেবিল তো আড্ডার জন্য আইডিয়াল জায়গা।”

“হবে হয়তো” নিঃস্পৃহ উত্তর মিঠির।

“তাহলে তুমি বেনিয়মে চলছ।”

“বেনিয়ম টাই আমার নিয়ম।” অপর্ণা তাড়াতাড়ি অবস্থার সামাল দেয়, হাওয়া টা ভারী হয়ে যাচ্ছিল বলে, “থাক আর নিয়ম-বেনিয়ম এ কাজ নেই। তার চেয়ে বলুন কেমন লাগল নৈশ্ ভোজ। আপনার ওই পার্ক প্লাজা না আমি কে বেশী নম্বর পাবে?” শুভজিত বলে উঠলো, “পার্ক প্লাজা কে নম্বর দিয়ে অকালে প্রাণটা হারাবে নাকি?”

সৌরভ বলল, “সে ভয়ও আছে বুঝি?”

ওরা হেসে ফেললো। মিঠি চুপ, হাসিটা কেমন বানানো লাগছিলো ওর, বলল, “আমি উঠছি।”

শুভজিত বলল, “একি মিঠি, সকলের খাওয়া হোক।” মিঠি বসে পড়লো। সৌরভ বলল, “আরে ওঠো, ওঠো। আমাদের তো হয়েই গেছে।” মিঠি উত্তর দেয়, “আপনার অনুমতির চেয়ে বাবার আদেশ অনেক বেশী ইম্পরট্যাণ্ট।” এবার শুভজিত গম্ভীর হয়, “যাও মিঠি, একজন অতিথি বা অসুস্থ মানুষের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ তা বোধহয় তোমাকে আমরা শেখাইনি। শুভজিত রাগ করলে মিঠিকে “তুমি” বলে। বাবা রেগে গেছে দেখে আস্তে করে বলে, “আই এম সরি, আমার অন্যায় হয়ে গেছে বাবা।”

চোখের জল আটকে রেখে নিজের ঘরে চলে যায় মিঠি।

                        [সাত]

পরদিন সকালে শুভজিত, সৌরভকে পাঠাল মিঠির ঘুম ভাঙ্গাতে। আজ সৌরভ কে সাময়িক ভাবে এই কাজটা করতে দিতে তার কষ্ট হয়নি বললে মিথ্যা বলা হবে। ঘুম চোখে ওদিকে মিঠিও শশব্যাস্ত হয়ে বলে, “বাবা কই? আপনি কেন?”

“গুঞ্জন মা আমার এত আভিমান?”

“আভিমান? আপনার উপর? কেন বলুন তো?”

“আমি সব বুঝি রে মা।”

“কিচ্ছু বোঝেন না আপনি” দাঁতে দাঁত চেপে কথা গুলো বলতে থাকে গুঞ্জন, “বুঝলে, বার বার এসে আমার আশান্তি বাড়াতেন না।”

“চুপ কর মা, চুপ কর। আর যা শাস্তি দিতে চাস দে, শুধু আমায় তোর কাছে আসতে বারণ করিস না।” বলেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরল বাবা। গুঞ্জন নিজেকে ছাড়িয়ে নিল না, অস্ফুটে জিজ্ঞেস করল, “শরীর ঠিক আছে তো তোমার বাবা।” সৌরভ কেঁদে ফেলে, “আর কিচ্ছু চাওয়ার নেই রে মা। তুই বাবা বললি আমায়। মরে গেলেও আর কোনও দুঃখও নেই মা রে।”

“এসব কি কথা? এসব বললে আর আসতে হবে না।”

“আচ্ছা বলব না।” মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সৌরভ। হঠাৎ মিঠির মনে হয় বাবার সাথে এতক্ষণ থাকলে ওরা বড্ড ইন্সিকিওর ফিল করবে। বলল, “তুমি যাও। আমি চেঞ্জ করে আসছি। বাবা শোন। তোমাকে ওদের সামনে ভালবাসবো না। বাবাও বলব না। যাও।” সৌরভ গুঞ্জনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আমার লক্ষী মেয়ে।”

                           [আট]

শুভজিতের সকালটা আজ অন্য নিয়মে শুরু হয়েছে। সে একটু চুপচাপ। অপর্ণা ভেবেছিল সৌরভ মিঠির ঘর থেকে এসে বলবে, “ও তোমার কন্যা তোমার ডাক ছাড়া উঠবে না।” কিন্তু ভাবনার সাথে বাস্তব মেলে না। সৌরভ এসে বলল, “ ও চেঞ্জ করে আসছে।” অপর্ণা এলোমেলো ভাবনা গুলোকে আরও এলোমেলো করতে করতে পাউরুটি তে মাখন লাগাচ্ছিল আর আড় চোখে শুভজিতের মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর কষ্ট টা। পারল না। মিঠি এসে নিজের জায়গায় বসল, চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সারল। ব্রেকফাস্ট টেবিলে যেন ঝড়ের পূর্বাভাষ। ঘড়ির টিক টিক, ফ্যানের আওয়াজ, চামচে, গেলাসে, ডিশে ওঠা বেসুরো শব্দরা যেন অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল, কোন কথা না বলেই। মিঠির খাওয়াই আগে শেষ হল। খাওয়ার টেবিল ছেড়ে উঠে মাটির দিকে তাকিয়ে আদরের মেয়েটি ধীর ভাবে বলল, “কাল থেকে তুমি আমার ঘুম ভাঙ্গিও বাবা।

Around The Web

Trending News

You May like