পুজো-পাঠ ২০২০: ‘দেবতার ফুল’, কলমে অর্পিতা ঘোষ
অর্পিতা ঘোষ:
নিতাইবাবু তার স্ত্রী কে বললেন– বাজারের ব্যা গটা দাও,তাড়াতাড়ি বাজার করে নিয়ে আসি।
অনিমা – আজ আর বাজারে যেতে হবে না, কাল যে তিনরকমের মাছ এনেছিলে তার থেকে ছয়পিস তুলে রেখেছি, শাক ও সবজি সবই আছে, তাই দিয়েই আজ চালিয়ে নেবো।
নিতাইবাবু – তবুও একবার ঢু মেরে আসি, দেখি ভালো চিংড়ি পায় কিনা, কাল যে লাউটা কিনেছি, তাই দিয়ে আজ লাউ চিংড়ি হবে।
কি আর বলেন অনিমা, মানুষটার এই এক স্বভাব, চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বাজার করতে না পারলে যেন হাপিয়ে ওঠে, বাজারে যাওয়াটা একটা নেশায় পরিনত হয়েছে।
– বাজারে যখন যাচ্ছ তখন আমার ঠাকুরের জন্য ফুল নিয়ে এসো।
– তুমি না বললেও নিয়ে আসতাম। ঠাকুরের ফুল আনা তো আমার দৈনিক রুটিন
বাজার বেশি দূরে না, হাটতে হাটতেই যান নিতাইবাবু। রাস্তায় চেনা লোক দেখলে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলেন। পুরো বাজারটা দুবার চক্কর মারেন, তারপর দেখে পছন্দ মতো ভালো জিনিসটা কেনেন। সেদিন বাজারে ঘুরে আরও কিছু সবজি কিনলেন। মাছের বাজারে গিয়ে দেখেন বেশ ভালো ট্যাংারা এসেছে, অনিমা ট্যাংদরা খেতে ভালোবাসে, তাই কিছুটা কিনলেন। তারপর চিংড়ি কিনলেন। এবার ফুল বিক্রি করে যে ছেলেটা তার কাছে গেলেন, ফুল নেওয়ার জন্য আলাদা একটা ছোট ব্যা্গ নিয়ে আসেন তিনি। ফুল নিতে গিয়ে তিনি দেখলেন যে ছেলেটার কাছ থেকে ফুল নেন আজ সে বসেনি, কি আর করবেন,পাশে এক মাসি বসে ফুল নিয়ে, তার কাছ থেকে ফুল কিনলেন। ওই ছেলেটা একদম টাটকা ফুল দেয়, নানারকমের ফুল বেলপাতা বৃহস্পতিবারে দূর্বা, সবকিছু সুন্দর করে গুছিয়ে দেয়। বাজার থেকে বেরিয়ে বাজারে ঢোকার মুখের দোকান থেকে একপ্যা কেট বিস্কুট কিনলেন, রোজ তিনি কেনেন তাই দোকানদারের জানা হয়ে গেছে। দোকানদার নিতাইবাবুকে দোকানের দিকে আসতে দেখলেই একপ্যানকেট বিস্কুট এগিয়ে দেয়। পয়সা দিয়ে পেছন ফিরেই দেখেন ওরা চারজন দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে, একটু পাশে গিয়ে ওদের বিস্কুট দেন। চারজনই লেজ নাড়তে নাড়তে বিস্কুট গুলো খায়, ওদের খাওয়া দেখে নিতাইবাবু তৃপ্তি পান। ভাবেন রাস্তার অবলা জীব ,ওদের যদি আমরা একটু খেতে না দিই তাহলে ওরাই বা খাবার পাবে কোথা থেকে। সবাই একটু একটু করে খাবার দেওয়াতেই তো ওদের পেট ভরে। কুকুর গুলোর খাওয়া শেষ হলে বাড়ির পথে পা বাড়ান, কুকুরগুলো পেছন পেছন খানিকটা এগিয়ে দেয় তারপর চলে যায়।
বাড়িতে ঢুকে বাজারের ব্যা গটা রাখার পরে অনিমার মুখে শোনেন অতনু সান্যাজল আর নেই, না ফেরার দেশে চলে গেছে। উনি বাজারে যাবার পর সবসময়ের কাজের মেয়ে মমতা এসে খবরটা দেয়...শোনা মাত্র নিতাইবাবুর বুকের ভেতরটা ছ্যা ত করে ওঠে। সেই ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছেন, একসাথে স্কুলে যাতায়ত করা, বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলা, আড্ডা, কখনো ঝগড়া তো কখনো গলা জড়িয়ে ধরে পথ চলা। একসময় পড়া শেষ করে চাকরির জন্য দরখাস্ত দেওয়া , সবকিছুই দুজনে একসাথে পরামর্শ করে করেছেন। দুজনেই দুজনার জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া, বিয়েতে কতো আনন্দ … এরকম নানান পু্রোনো খাতা ভর্তি স্মৃতি ভেসে আসে চোখে। অতনু তাহলে ওকে একা রেখে চলে গেল, এই প্রথম অতনু ওকে না বলে গেল। বুকের ভেতরে কেমন চাপ ধরে আসছে, চোখে আবছা দেখছেন।
নিতাইবাবু অনিমাকে বললেন–তুমি সব বাজার ফ্রিজে ঢুকিয়ে দাও, আজ আর কিছু রান্না করতে হবে না, আমি অতনুর বাড়ি যাচ্ছি।
অনিমা– একটু দাড়াও, আমি ও যাব তোমার সাথে। কৃষ্ণা কি করছে কি জানি, ওর পাশে এসময় একটু থাকবো, তাহলে বুকে একটু বল পাবে ...কৃষ্ণা অতনুর স্ত্রী।
অনিমাদেবী তাড়াতাড়ি করে গায়ে একটা শাড়ি জড়িয়ে মমতাকে বললেন–আজ আর আমাদের জন্য কিছু রান্না করতে হবে না, ভাতে সেদ্ধ ভাত করো, আমরা আসছি,দেরী হলে তুমি তোমার মতো খেয়ে নিও।
দুজনে অতনুর বাড়ির দিকে গেলেন। অতনুর স্ত্রী কৃষ্ণা অনিমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদতে লাগলো। নিতাইবাবু অতনুর খাটের পাশে চুপচাপ বসে থাকলেন। অতনুর ছেলে বাপ্পা এতো দুঃখের ভেতরেও ব্যেস্ত হয়ে পড়েছে, ওর অনেক বন্ধুরা এসেছে। একে একে খাট মালা ফুল ও আর যা যা জিনিস লাগে সব আনলো বাপ্পার বন্ধুরা।
অতনুকে খাটে শোয়ানো হলো। অতনুর ছেলে বাপ্পা নিতাইবাবুকে জিজ্ঞাসা করলো– কাকু তুমি কি আমাদের সাথে যাবে?
নিতাইবাবু – হ্যাঁ বাবা, ছোট থেকে তো আমরা একসাথে বড় হয়েছি, তাই ওর শেষ সময়েও আমি ওর পাশে, ওর কাছে থাকতে চাই।
বাড়ি থেকে শ্মশান দশ কিলোমিটার দূরে। দেখতে দেখতে শ্মশানে যাবার সময় হয়ে গেল। বাপ্পা নিতাইবাবুকে একটা নতুন গামছা দিয়ে বললো– কাকু এটা ঘরে ছিল নাও, ওখানে গঙ্গায় স্নান করার সময় লাগবে।
নিতাইবাবু ভাবলেন...ছেলেটার চারিদিকে খেয়াল আছে, আর এখনতো সবকিছু ওকেই খেয়াল রাখতে হবে।
নিতাইবাবু অন্য গাড়িতে উঠে বসলেন, সারা রাস্তা কারোর সাথে বেশি কথা বললেন না, যে মানুষটা কথা বলতে ভালোবাসেন সেই মানুষটাকে চুপচাপ থাকতে দেখে সবাই একটু অবাকই হলো। অতনুকে খুব ভালোবাসতেন নিতাইবাবু, তাই হয়তো চুপচাপ....সবাই জানে নিতাই আর অতনু দুজনে অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল।
কাউকে কিছু না বলে চলে গেল ,অন্তত ওকে তো কিছু বলতে পারতো, কাল সন্ধ্যেতেই তো কতো গল্প হলো। আর আজ হঠাৎ ঘুমের ঘোরে হার্টফেল করলো। একদম একা করে দিয়ে গেল অতনুটা। এসব কথাই চুপচাপ বসে ভাবছিল নিতাইবাবু। ভাবনার ছেদ পরলো, শ্মশান এসে গেছে, গাড়ির দরজা খুলে নামার জন্য ডাকছে।
নীচে নামলেন নিতাইবাবু, সবার পেছন পেছন শ্মশানে গেলেন, এখনতো ইলেকট্রিক চুল্লিতে শব পোড়ানো হয় তাই দেরী হবেনা, তবে নাম লেখাতে হবে, লাইন ফাঁকা থাকলে তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। বাপ্পার এক বন্ধু কাগজপত্র নিয়ে নাম লেখাতে গেল। একটা বেঞ্চের ওপর বসলেন নিতাইবাবু, একজন লিকার চা দিয়ে গেল, খেতে ইচ্ছা করছিল না, তবুও খেলেন।
এই সময় হঠাৎ নিতাইবাবুর মনে হলো বাজারে ফুল বিক্রি করে যে ছেলেটা তাকে দেখলেন, ভাবলেন ওরও মনে হয় কেউ মারা গেছে, তাই শ্মশানে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে আবার দেখলেন ওকে, এবার বুঝলেন ওর কেউ মারা যায়নি, এখানে কাজ করে।
নিতাইবাবু আস্তে আস্তে হেঁটে ছেলেটার কাছে গেলেন। নিতাইবাবুকে দেখে ছেলেটা থতমত খেলো।
– কাকু আপনি এখানে?
নিতাইবাবু ওকে বললেন ওনার বন্ধু মারা গেছে। তারপর ওকে জিঙ্গাসা করলেন –তুমি এখানে কি করছো?
–কাকু আপনি কাউকে বলবেন না আমি ডোম। মায়ের অসুখ, ওষুধ কেনার জন্য অনেক টাকার দরকার, এখানে যা পায় তাতে কোনোরকমে খাওয়াটা হয় কিন্তু ওষুধ কেনার জন্য তো পয়সার দরকার। ডোম বলে কেউ কোনো কাজে নেয়না। মা বাড়িতে অনেক ফুলগাছ লাগিয়েছে, তাতে এখন প্রচুর ফুল ফোঁটে । ভাবলাম ঐ ফুল ঠাকুরের চরণে পড়লে ঠাকুরের আশীর্বাদে আমার মা সুস্থ হয়ে উঠবে, আর আমার হাতেও কিছু পয়সা আসবে তা দিয়ে মায়ের ওষুধপথ্য কিনবো। এক নীচুজাত মায়ের লাগানো গাছের ফুল দিয়ে আর এক দেবীমায়ের পূজো করা কি অপরাধ? ভগবানই তো আমাদের নীচু জাতের ঘরে জন্ম দিয়েছেন, তাহলে আমরা যদি তার পূজোর ফুল দিই তাহলে দোষ কোথায়?
আমার দুর্ভাগ্য আপনি আমাকে দেখে ফেললেন, আমি আর ফুল বিক্রি করতে পারবোনা। আমার মা ওষুধ না খেয়ে মারা যাবে। কি আর করবো....এই বলে অতো বড় ছেলেটা কাঁদতে লাগলো।
নিতাইবাবু ওর মাথায় হাত দিলেন, বললেন– বাবা তুমি বাজারে আগের মতোই ফুল বিক্রি কোরো, আমি কাউকে কিছু বলবোনা, এখানে আজ আমাদের ওখানকার অনেকে এসেছে, তোমার কাধের গামছাটা নিয়ে ঘোমটা দিয়ে মুখটা একটু আড়াল করে রাখো, যাতে তোমাকে কেউ চিনতে না পারে। কেননা আমাদের সমাজে অনেকেই এখনো কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন। তুমি তোমার মাকে সুস্থ করে তোলো, ঈশ্বর তোমার বাড়ির ফুলেই পূজিত হতে চাইছেন, তাইতো তোমার বাড়িতে ওতো নানারকমের ফুল ফোঁটে। আমি আগের মতো তোমার কাছ থেকেই ফুল কিনবো।
ছেলেটা তখন নীচু হয়ে নিতাইবাবুকে প্রণাম করলো, বললো– কাকু আপনার মতন মানুষ যেন সবাই হয়।