সুনন্দা বারুই: নরম, তুলতুলে, ধবধবে ফর্সা গোলগাল এই একরত্তিটা বাঙালির হৃদয়জুড়ে৷ পরম আদরের,পরম আবেগের৷ তাই তার জন্মদিনে একটু মিষ্টিমুখ না হলে চলে? আসলে,তার নামেই যে মিষ্টিমুখ হয়ে যায়৷ বাঙালির যেকোনো শুভ কাজ তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ৷ এই সূত্র ধরে এগোলে একটাই নাম মনে পড়ে ‘রসগোল্লা’৷
বিগত দুশতক ধরে বাংলীর মিষ্টি প্রীতির তালিকায় এর দ্বিতীয় প্রতিযোগী আর পাওয়া যায়নি৷ এই ২১শতকের এতশত ‘হাইপ্রোফাইল ডেসার্টের’ মধ্যেও রসগোল্লা নিয়ে উৎসাহ ও কৌতূহলের সীমা নেই৷ তাই সম্প্রতি খাতায়কলমে ভারতসরকারের জিআই মান্যতা পাওয়ার দিনটিকে রসগোল্লার বার্থ ডে হিসেবে সেলিব্রেশনে করার আগে এর প্রকৃত জন্মতত্ব নিয়ে ইতিহাস আর গবেষনা কি কি বলছেন তার একটা ধারণা থাকা প্রয়োজন৷
রসগোল্লা নিয়ে এযাবৎ গবেষণায় উঠে এসেছে নানান তথ্য, বিতর্কও কম নেই৷ ১৮৬৮ সালে কলকাতার বাগবাজার থেকে শুরু হয় রসগোল্লার ইতিহাস৷ কথিত আছে, একদিন বাগবাজারের তত্কালীন বিখ্যাত কবিয়াল ‘ভোলা ময়রা’র মেয়ে৷ ছোট্ট ক্ষীরোদমনি নাকি নবীন দাসের কাছে আবদার করে, ‘চটচটে নয়, শুকনো হতে মানা,/ দেখতে হবে ধবধবে চাঁদপানা,/ এমন মিষ্টি ভূ-ভারতে নাই,/ নবীন ময়রা, এমন মিষ্টি চাই৷’’ ছোট্ট মেয়েটির আবদার রাখতে তার বলে দেওয়া প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে নবীন দাস বানিয়ে ফেললেন ‘রসগোল্লা’৷ আর এই মিষ্টির সূত্র ধরেই ক্ষীরোদমনির সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন নবীন দাস৷
অবশ্য নবীনচন্দ্র দাসের উত্তরসূরী, পঞ্চম প্রজন্মের ধীমান দাসের কথায় রবীন্দ্রনাথের পাড়া জোড়াসাঁকোতে ১৮৬৪ সালে একটি মিষ্টির দোকান করেছিলেন চিনি ব্যাবসায়ী নবীনচন্দ্র দাস৷ সেই ব্যবসায় তেমন সাড়া পাচ্ছিলেন না৷ দুবছর এইভাবে চলার পর ১৮৬৮ সালে বাগবাজারে তিনি আবারও একটি মিষ্টির দোকান বানিয়ে ফেলেন৷ সেখানেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালির সবথেকে পছন্দের মিষ্টি রসগোল্লা৷ তাঁর ছেলে কৃষ্ণচন্দ্র দাস প্রথম কৌটজাত রসগোল্লার ধারণা আনেন৷ যা পরবর্তীতে বিদেশে রপ্তানীর ক্ষেত্রে সহায়ক হয়৷
এদিকে কেউ আবার বলেছেন, রানাঘাটের হারাধন ময়রাই প্রথম রসগোল্লা বানান৷ একবার তার মিষ্টির দোকানে চিনির রসে অসাবধানতাবশত কিছু ছানার গোল্লা পড়ে যায়৷ আর সেটাই হয়ে যায় রসগোল্লা৷ রসগোল্লার উৎপত্তিস্থল হিসেবে এরাজ্যের নদিয়া এবং ফুলিয়ার নামও তুলে ধরেছেন অনেকেই৷
কিন্তু রসগোল্লা নিয়ে বিতর্ক যে শুধু এপার বাংলায় তা নয়, ওপার বাংলাতেও৷ সেখানে থেকে উঠে আসায় তথ্য অনুযায়ী- প্রতিবেশী বাংলাদেশ তখনও এই বাংলার অঙ্গ ছিল৷ তাই সেখানকার গবেষকরা ভিন্নমত পোষণ করে বলেছেন, নবীন দাস ওপাবাংলার বরিশাল অঞ্চলে পটুয়াখালীর কাছে থাকতেন৷ সেখানেই প্রথম রসগোল্লা তৈরি করেছিলেন৷ তারপর তার হাত ধরেই কলকাতায় পৌঁছোয় এই যুগান্তকারী মিষ্টি৷ এই তথ্য নিয়েও দ্বিমত আছে বাংলাদেশের গবেষকদের মধ্যে৷
কারো মতে পর্তুগিজদের সময় পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার ময়রারা ছানা, চিনি, দুধ ও সুজি দিয়ে গোলাকার এক ধরণের মিষ্টান্ন তৈরি করেছিলেন৷ সেটাই ছিল ক্ষীরমোহন বা রসগোল্লা৷ তবে দুই বাংলার সব তত্ব খারিজ করে রসগোল্লার আবিষ্কার নিয়ে তাদের ৮০০ বছরের পুরনো ইতিহাস তুলে ধরে এই মিষ্টি তাদের পুরনো ও নিজস্ব আবিষ্কার বলে দাবি করে ওড়িশা৷ তাদের প্রচলিত মত, রথযাত্রা শেষে সাত দিন মাসির বাড়ি কাটিয়ে মন্দিরে ফেরার সময় একহাঁড়ি রসগোল্লা দিয়ে স্ত্রী লক্ষ্মীর মানভঞ্জন করেছিলেন জগন্নাথ৷ হাঁড়ি ভর্তি এই রসালো মিষ্টিই ছিল তাঁর মন্দিরে ঢোকার ছাড়পত্র৷
রসগোল্লার জন্মবিত্তান্ত নিয়ে ওড়িশায় এই দাবি বছর দশেক আগে স্যোশাল মিডিয়া ‘অরকুটের’ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে৷ আর তারপর থেকেই যত বিপত্তি৷ রসগোল্লার সত্বাধিকার নিয়ে রীতিমত হৈচৈ শুরু হয়ে যায়৷ অভাবনীয় ভাবে একটা মিষ্টি নিয়ে বিতর্ক গড়ায় আদালত পর্যন্ত৷ তবে এ মিষ্টি তো আর যেমন তেমন নয়, বাংলার গন্ডি ছাড়িয়ে দেশ থেকে বিদেশ পর্যন্ত রসগোল্লার খ্যাতি৷ অবশেষে সমস্ত দিক থেকে পর্যবেক্ষণ করে ওড়িশায় দাবি কার্যত উড়িয়ে দিয়ে বাংলাকেই মান্যতা দেয়৷
আসলে তাঁর তৈরি রসগোল্লার কদর দুদশক পরেও স্বমহিমায় বাঙালির হৃদয়জুড়ে থাকবে আর তার কৃতিত্বে ভাগ বসাতে আসবে অন্য কেউ তা হয়তো স্বপ্নেও কল্পনা করেননি ‘রসগোল্লার কলম্বাস’৷ তাই এই মিষ্টি তৈরির দিনক্ষণও লিখে রেখে যাননি৷
তাতে কি? বাংলার নবপ্রজন্ম কগজেকলমে রসগোল্লার বার্থ সার্টিফিকেট হাতে পেয়ে গেছে৷ তাই ২০১৭ সালে ভারতসরকারের জিআই মান্যতা পাওয়ার দিন অর্থাৎ ১৪ নভেম্বরই এখন বাংলার ঐতিহ্য মিষ্টিরাজ রসগোল্লার জন্মদিন৷ শুভ জন্মদিন!