পুজো এলেই জমিদারবাড়ির নহবৎ খানায় বেজে ওঠে সানাই

পুজো এলেই জমিদারবাড়ির নহবৎ খানায় বেজে ওঠে সানাই

বাঁকুড়া: জনশ্রুতি,  নীলের ব্যবসা করে মণ্ডলরা তখন আর্থিক দিক থেকে বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছেন। ঠিক সেই সময় নীল বিক্রি করে প্রচুর ধন সম্পদ নিয়ে বজরায় করে গ্রামে ফেরার পথে কোন এক জায়গায় জল দস্যুদের কবলে পড়েছিল মণ্ডল বাড়ির তৎকালীন এক সদস্য। জল দস্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় না পেয়ে দেবী দুর্গার স্মরণাপন্ন হন। আর তাই বেঁচে ফিরলে বজরায় থাকা যাবতীয় সম্পত্তি দুর্গার নামে দেবোত্তর করে দেওয়ার মানত করেন তিনি। পরে তিনি সুস্থ শরীরে বাড়ি ফিরে এলে ওই বজরায় থাকা সমস্ত ধন সম্পদ দিয়ে বিশাল দুর্গা দালান, রাস মঞ্চ, রথ মন্দির, নাট মন্দির, নহবত খানা তৈরি মানত শোধ করেন তিনি।

সেই শুরু৷ ৩০০ আগে শুরু হওয়া সেই পুজোকে ঘিরে আজও এলাকার মানুষের উন্মাদনায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। শুরুর গল্পটা এই রকম: সালটা ১৭১২-৪৮। সেই সময় বিষ্ণুপুরের  গোপাল সিংহ ও চৈতন্য সিংহের আমল। ঠিক সেই সময় বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে বর্তমান পাত্রসায়রের হদল গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন জনৈক মুচিরাম ঘোষ । পরে বিষ্ণুপুর মল্লরাজাদের দেওয়ান  শুভঙ্কর রায়ের সৌজন্যে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি। আর সেই সূত্র ধরেই মল্ল রাজাদের দাক্ষিন্যেই নামমাত্র খাজনার বিনিময়ে দামোদরের উপনদী বোদাই এর তীরে পারুলিয়া পরগণার বিশাল জমিদারী লাভ করার পাশাশি ‘মণ্ডল’ উপাধি পান মুচিরাম । পরবর্তীকালে বেশ কিছু নীলকুঠি পরিচালনা করে বিশাল সম্পত্তি র মালিক হন তিনি। আর্থিক প্রাচূর্যের ফলে বাঁকুড়ার হদল ও নারায়ানপুর গ্রামের মাঝে তৈরি হয় বিশাল জমিদারবাড়ি। শুরু হয় দুর্গা পুজাও। ৩০০ আগে শুরু হওয়া সেই পুজোকে ঘিরে আজও এলাকার মানুষের উন্মাদনায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। 

পরিবারের এক সদস্য জানালেন, সেই সময় বংশ পরম্পরায় পুজা পরিচালনার  জন্য বহু জমি ও পুকুর কিনে সেগুলি দুর্গার নামে দেবোত্তর করেছিলেন উত্তরসূরীরা। এক দিকে নীল কুঠির বিপুল আয় অন্যদিকে বিশাল জমিদারির খাজনায় ফুলে ফেপে ওঠে রাজকোষ। প্রত্যাশিতভাবে তার প্রভাব পড়ে দুর্গোৎসব পরিচালনাতেও। সেই সময় পুজোয় টানা সাত দিন নহবৎ খানায় বসত নহবৎ। দুর্গা মন্দির সহ সমস্ত মন্দির সাজানো হত বেলজিয়াম গ্লাসের বিশাল বিশাল ঝাড়বাতিতে।  বসতো পুতুল নাচের আসর, হতো যাত্রাপালাও।

দুর্গা পুজার প্রতিটি নির্ঘণ্ট ঘোষিত হত তোপ ধ্বনির দ্বারা। দূর দূরান্তের অসংখ্য মানুষ আর  প্রজারা হাজির হতেন মণ্ডলদের জমিদারবাড়িতে। আজ আর সেই নীল কুঠিও নেই, নেই জমিদারীও। তবু বিশাল দেবোত্তর সম্পত্তির আয়ে দুর্গা পুজায় আয়োজনের ত্রুটি রাখেন না মণ্ডল বাড়ির বর্তমান প্রজন্ম। আজও পুজো এলেই মণ্ডল জমিদারবাড়ির নহবৎ খানায় বেজে ওঠে সানাই।  ভাঁড়ার ঘর থেকে পুরানো দিনের সেই ঝাড়বাতি বের করে তার ধুলো ঝেড়ে দুর্গাদালানে টাঙানো হয়। এমনকি কর্মসূত্রে দেশ বিদেশে ছড়িয়ে থাকা পরিবারের সদস্যরা আজও  পুজোর দিন গুলিতে পূর্ব পুরুষের ভিটেয় ছুটে আসেন শুধুমাত্র ইতিহাস কে আরো একবার ছুঁয়ে দেখার লোভে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

seventeen − two =