নিউইয়র্ক: এই অতিমারি একদিন শেষ হবে৷ তখন আবার দেখা হবে আমাদের৷ কিন্তু তখনও কি পৃথিবীটা একই রকম থাকবে? যৌথভাবে যে সংকটের মোকাবিলা আমরা করে চলেছি, তা থেকে নতুন কিছু শিখব কি? আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের লেখায়, কোভিড-১৯ এর আগেও এই দুনিয়ায় নানা সমস্যা ছিল৷ কোথাও লাগামছাড়া অসাম্য তো কোথাও চিকিৎসার অভাব৷ এসেছে অনেক মহামারি৷ অতিমাত্রায় কঠোরতার জন্য দুর্বল মানুষের জন্য কিছু করতে পারছিল না ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ ব্রাজিল থেকে বলিভিয়া, পোল্যান্ড থেকে হাঙ্গেরি- সর্বত্রই মাথাচাড়া দিচ্ছিল গণতন্ত্র বিরোধী রাজনীতি৷
তবে এই সংকটে একত্রে কাজ করার যে প্রয়োজনবোধ তৈরি হয়েছে, তা ভবিষ্যতের গণকর্মকাণ্ডে হয়তো একটা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে৷ এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছে৷ বিশ্বযুদ্ধে পর আন্তর্জাতিক সহযোগিতার উপর অত্যন্ত গুরত্ব দেওয়া হয়েছিল৷ রাষ্ট্রসংঘ, আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার এবং বিশ্বব্যাঙ্ক ১৯৪৪-’৪৫-এর মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করা হয়। ভেরা লিনের ‘উই উইল মিট এগেইন’ গানটি গাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ঘটনাগুলি ঘটে৷ এই অভিজ্ঞতা থেকে কোনও দেশ কি দীর্ঘমেয়াদি কোনও উন্নতির শিক্ষা লাভ করতে পারে? এর কয়েকটা ইঙ্গিত অবশ্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংলন্ডে দেখা দিয়েছিল খাদ্যাভাব৷ চারিদিকে শুধুই অপুষ্টির ছাপ৷ কিন্তু যুদ্ধের পর ক্রমেই তা কমতে শুরু করে৷ খাবারের জোগানের সমস্যা মেটাতে রানির দেশে শুরু হয় রেশনিং ব্যবস্থা৷ এছাড়াও সামাজিক স্তরে নানা বাধা-নিষেধ আরোপ করে খাদ্যের সমবণ্টন চালু করে ইংলন্ড৷ অপুষ্টি মেটাতে তাদের এই কৌশল কাজে আসে৷ এমনকী চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও এই বণ্টন ব্যবস্থার সুফল মেলে৷
এই পদক্ষেপের ফলে ১৯৪০-এর দশকে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে সদ্যোজাত ছেলেদের সম্ভাব্য আয়ুসীমা ৬.৫ বছর করে বেড়ে যায়৷ আগের দশকে যা ছিল ১.২ বছর৷ সদ্যোজাত মেয়েদের ক্ষেত্রে যুদ্ধের দশকে সম্ভাব্য আয়ুসীমা ১.৫ বছর থেকে বেড়ে হয় ৭ বছর৷ বৈষম্য দূর করে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং পিছিয়ে পড়া মানুষগুলির দিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলে যে অবস্থার পরিবর্তন হয়, তাঁকে আমরা ‘কল্যাণকর রাষ্ট্রব্যবস্থা’ বলে থাকি। যুদ্ধের সময় এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালে ইংল্যান্ডে প্রথম ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস হাসপাতাল, ম্যানচেস্টারের পার্ক হসপিটাল উদ্বোধন করেন সামাজিক ন্যায়ের অন্যতম প্রবক্তা আনেউরি বেভান৷
সাম্প্রতিক এই সঙ্কট থেকে কি কোনও ইতিবাচক ঘটনা ঘটতে চলেছে? একটা সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে গিয়ে যে শিক্ষাটা আমরা পাই, তা নির্ভর করে সেই সমস্যা মোকাবিলার পন্থা কী ছিল এবং কোন সমস্যাগুলির আশু সমাধান করা হল তার উপর। অমর্ত্য সেন মনে করেন, এ ক্ষেত্রে রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে৷ জড়িয়ে রয়েছে শাসক আর শাসিতের সম্পর্ক৷ বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে যে সংকট দেখা দিয়েছিল, তা খণ্ডাতে সদর্থক ভূমিকা নেয় ইংল্যান্ড৷ খাদ্যের সুষম বণ্টন আর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত করে পরিস্থিতি সামাল দেয়৷ অথচ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেরই অপর এক অংশ বাংলায় ঘটেছিল ১৯৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষ এই মন্বন্তরে প্রাণ হারান৷ অথচ এই দুর্ভিক্ষ আটকানোর জন্য প্রায় কিছুই করেনি ব্রিটিশ সরকার৷
সাম্প্রতিক অতিমারির ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায়ের বিষয়টি তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। কারণ, আমেরিকায় সাদা চামরার মানুষের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রায় করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন আফ্রিকান আমেরিকানরা৷ শিকাগোয় এই অতিমারিতে যত জন মারা গিয়েছেন, তার মধ্যে ৭০ শতাংশ আফ্রিকান আমেরিকান৷ তবে ব্রাজিল, হাঙ্গেরি অথবা ভারতের ক্ষেত্রে এই বৈষম্য সুস্পষ্ট৷ ভারতের সমাজে পরতে পরতে রয়েছে অসাম্য৷ স্বাধীনতার পর থেকে এদেশে দুর্ভিক্ষ ঘটেনি। তা সত্ত্বেও গণ-সমাজের আলোচনায় বারবার উঠে এসেছে বঞ্চিত মানুষের কথা, বিপন্নকে সুরক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার প্রসঙ্গ, এই বিষয়ে সরকারি স্তরে বিভিন্ন বাধা প্রদান, সেই সঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে খর্ব করার কথা৷
ভারতের একদিকে আর্থিক ভাবে সচ্ছল মানুষের জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থার অধিকতর সুবন্দোবস্ত রয়েছে৷ অন্যদিকে, গরিব মানুষগুলি প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিষেবাও সুষ্ঠুভাবে পাচ্ছে না৷ এই বৈপরীত্যের সঙ্গে আধুনিক জাতপাত-ভিত্তিক অসাম্য এমন এক অবস্থা তৈরি করেছে, যা থেকে ভারত এই অতিমারি মোকাবিলা করতে গিয়ে বিপুল ভাবে উপকৃত হতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত ভারতে সাম্যাবস্থ প্রতিষ্ঠার কোনও চেষ্টা নজরে আসেনি৷ আচমকা লকডাউনে ট্রেন-বাস বন্ধ করার আগে একবারেও তরেও ভাবা হয়নি পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা৷ দরিদ্র মানুষগুলি নিজেদের বাড়ি থেকে বহু দূরে এক অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে রয়েছে৷
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করতে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং যে অব্যর্থ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই৷ কিন্তু এর আগে পরিপূরক ব্যবস্থা প্রয়োজন। লকডাউনের জেরে উদ্ভূত সমস্যায় মানুষের আয়, খাদ্য, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা প্রয়োজন৷ অনেক দেশের মতো ভারতেরও ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস প্রয়োজন। কিন্তু এই অতিমারি থেকে সে দিকে কোনও প্রবণতা কি দেখা দেবে? দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আবার যখন আমাদের দেখা হবে, আমরা সেই ফেলে আসা অসাম্যের পৃথিবীর থেকে খুব দূরে চলে যাব না৷ আনন্দবাজার পত্রিকায় লিখেছেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন৷