ক্লাবকে টাকা! পর্দাফাঁস হতেই সাংবাদিককে হুমকি, বাড়িতে তাণ্ডব! চ্যানেল বন্ধ করল পরিবার

ক্লাবকে টাকা! পর্দাফাঁস হতেই সাংবাদিককে হুমকি, বাড়িতে তাণ্ডব! চ্যানেল বন্ধ করল পরিবার

আরামবাগ: ফের আক্রান্ত গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ সাংবাদিকতার মাশুল গুনতে হল আরামবাগ ওয়েব টিভি চ্যানেলের সম্পাদক সেখ রফিকুল ইসলামের পরিবারকে৷ মাঝরাতে চলল তাণ্ডব৷ খবর প্রকাশের  কণ্ঠরোধে লেখা হল এক লজ্জাজনক অধ্যায়৷

প্রশাসনের বিরুদ্ধে বেশ কিছু দিন ধরেই লাগাতার খবর করছিলেন রফিকুল ইসলামের ওয়েব নিউজ চ্যানেল আরামবাগ টিভি৷ একের পর এক পর্দা ফাঁস হতেই শুরু হয় হুমকি৷ দেখতে হয় প্রশাসনের রক্তচক্ষু৷ ৫ তারিখ রাতের অন্ধকারে রফিকুল ইসলামের বাড়ি ঘিরে ফেলে ৩০-৪০ জন লোক৷ তাঁরা পুলিশ না দুষ্কৃতী সে বিষয়ে নিশ্চিত নন রফিকুল ইসলামের স্ত্রী আলিমা খাতুন৷ তবে তিনি জানান, মাঝ রাতে তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে ক্রমাগত হুমকি দিতে থাকে জনা ৪০শের ওই দল৷ বাড়ির দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে ভেঙে ফেলার চেষ্টাও করা হয়৷ ভয় দেখানো হয় তাঁদের সন্তানদের৷ 

‘সত্য’ ঘটনা প্রকাশের ‘অপরাধে’ গত সপ্তাহে একাধিক এফআইআর করা হয়েছিল এই ওয়েব টিভি চ্যানেলের বিরুদ্ধে৷ ক্রমাগত চাপ আসছিল তাঁদের উপর৷ তাই সন্তানদের জীবনের স্বার্থে টিভি চ্যানেল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন তিনি৷ আলিমা বলেন, স্বামীর জীবনের ভয়ে নয়, সন্তানদের জন্যই এই সিদ্ধান্ত৷

আলিমা খাতুন জানান, ঘটনার রাতে নিজেদের ঘরে ঘুমাচ্ছিল তাঁদের দুই সন্তান৷ বাচ্চাদের ঘরের জানলা খুলে টর্চের আলো ফেলে তাদের ভয় দেখানো হয়৷ আচমকা এই তাণ্ডবে আতঙ্কিত হয়ে পরে তাঁর দুই সন্তান৷ আতঙ্কে ঘুমাতে পর্যন্ত পারেনি তারা৷ তিনি বলেন, রফিকুল ইসলাম কোনও দিনও মিথ্যে খবর করেনি৷ মিথ্যার পর্দা সরিয়ে বরাবর তিনি সত্য ঘটনাকে তুলে ধরেছেন৷ কিন্তু এই পরিস্থিতিতে কি একটা চ্যানেল চালানো সম্ভব? প্রশ্ন তোলেন আলিমা৷ তিনি বলেন, এমন রাজনীতির দৃষ্টান্ত শুধু বাংলাতেই মেলে৷ অন্য কোথাও নয়৷

আলিমা বলেন, সত্য খবর প্রচারের দায়ে প্রশাসনের বিষ নজরে পড়েছে আরামবাগ টিভি৷ এর আগে যে সকল সংবাদমাধ্যমে কাজ করেছেন রফিকুল, সেখানে এমনও হয়েছে যে ক্যমেরায় বন্দি সত্য ঘটনার ফুটেজকে মিথ্যে বলে প্রকাশ করা হয়েছে৷ সেই ধিৎকারে চাকরি ছেড়েছিলেন রফিকুল৷ মিথ্যের শিকল ভেঙে সত্য ঘটনা অনুসন্ধানের তাগিদেই তৈরি করেন নিজের ওয়েব চ্যানেল৷ সত্য ঘটনাই এই চ্যানেলের বুনিয়াদ বলে দাবি করা হয়৷ শুরু থেকে স্থানীয় মানুষের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘আরামবাগ টিভি’৷ কিন্তু প্রশাসনের ভূমিকায় তিনি স্তম্ভিত৷ আলিমা খাতুন জানান, ঘটনার দিন রাত ৭টার সময় তাঁদের নোটিশ পাঠানো হয়৷ এর পর রাত ১টা-দেড়টা নাগাদ তাঁদের বাড়ির দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়৷ সারা দিন রোজা রেখে রাতে শুয়েছিলেন তাঁরা৷ কিন্তু সেই ঘুম পণ্ড করে চলতে থাকে হুমকি৷

তিনি বলেন, সত্যের গলা টিপে ধরতে চাইছে প্রশাসন৷ এটা কী ধরনের রাজনীতি? একটা চ্যানেলের টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা হচ্ছে৷ ক্রমাগত চ্যানেলের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে৷ আইন কি পুলিশের জন্য নয়? স্বাধীনতার এত বছর পরেও সংবাদমাধ্যমের শ্বাসরোধ করার এই জঘন্য চেষ্টা মেনে নেওয়া যায় না৷  রফিকুল ইসলাম কোনও দিনও জীবনের পরোয়া করে খবর করেননি৷ তিনি যখনই সামনে এসেছেন সত্যকে তুলে ধরেছেন৷ কিন্তু সন্তানদের জীবনের স্বার্থে চ্যানেল বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি৷ আলিমা বলেন, যেদিন সত্য ঘটনা প্রকাশ করার সুযোগ আসবে, সেদিন আবার এয়ার হবে আরামবাগ টিভি চ্যানেল৷    

এদিকে, ঘটনার রাতেই নিজের ঘর থেকে ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও করেন রফিকুল ইসলাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের বাড়ির চারিদিক ঘিরে ফেলা হয়েছে৷ তারা পুলিশ না দুষ্কৃতি সেই বিষয়ে নিশ্চিত নই৷ তারা হয়তো বাড়ির দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করবে৷ আমাকে গ্রেফতারও করা হতে পারে কিংবা মারধরও করা হতে পারে৷ আমার লড়াইয়ে আপনারা পাশে আছেন৷’’

করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিকের মধ্যেও রাজ্য সরকারের ক্লাবগুলিকে ডোনেশন দেওয়ার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিল আরামবাগ টিভি৷ যে ৫৯টি ক্লাবকে ১ লক্ষ করে টাকা দেওয়া হয়েছিল, সেই ক্লাবগুলির ছবি এবং নামের তালিকা প্রকাশ করে দেন রফিকুল৷ এদের মধ্যে কতগুলি ক্লাবের প্রকৃত অস্তিত্ব আছে কিনা, সেই বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি৷ এছাড়া স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় রাজ্যের অব্যবস্থার বিরুদ্ধেও তিনি সুর চড়ান৷ এর পরেই রফিকুল ইসলাম এবং  সাংবাদিক সুরজ আলি খানের বিরুদ্ধে আরামবাগ থানায় একাধিক এফআইআর দায়ের করা হয়৷ নোটিশ ধরানো হয় তাঁদের হাতে৷ কিন্তু তাতে এফআইআর-এর নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ ছিল না৷

এর আগে প্রথমসারির এক সংবাদপত্রেও ভুয়ো ক্লাবগুলির নাম প্রকাশ করা হয়েছিল৷ কিন্তু আরামবাগ টিভি সেই ঘটনা তুলে ধরার পরই তাদের টার্গেট করা হয় বলে অভিযোগ৷ রফিকুল ইসলামের দাবি, তাঁদের ওয়েব চ্যানেল বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে৷

এই ঘটনার নিন্দা করে আরামবাগ টিভির পাশে দাঁড়িয়েছেন বিরোধী নেতারা৷ প্রদেশ কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলায় সততার দাম নেই, নিরপেক্ষতার দাম নেই৷ আরামবাগ টিভির মতো একটি ছোট্ট সংস্থার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে সরকারি দল৷ তাঁদের এই সাহসিকতাকে মর্যাদা দিয়ে একজন রাজনীতিবিদ হিসাবে, বাংলার একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার করছি৷’

বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘‘আরামবাগ টিভির পাশে আমাদের থাকা উচিত৷ থাকব৷ আরামবাগ একটা ছোট সাবডিভিশন শহর৷ ছোট্ট একটা টিভি চ্যানেল৷ তাঁদের নিয়েও শাসক দলের গাত্রদাহ হচ্ছে৷ এত ভয় কিসের? আমরা আরামবাগ টিভির পাশে আছি৷’’ রফিকুলের সংস্থার পাশে দাঁড়িয়েছেন বিজেপি নেতা অর্জুন সিং৷ তিনি বলেন, মিডিয়াকে ভয় দেখিয়ে সত্য কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চায় না সরকার৷ কাউকে ভয় দেখাচ্ছে, কারোর নামে মিথ্যা মামলা করা হচ্ছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *