ওয়াকফ-ঘিরে হিংসা: পশ্চিমবঙ্গ কি ‘পরিকল্পিত অস্থিরতার’ নাট্যমঞ্চে পরিণত হচ্ছে?

ভারতের সংশোধিত ওয়াকফ আইন ২০২৪ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। আইনটি নিজেকে ‘ধর্মীয় সম্পত্তিতে স্বচ্ছতা’ আনার প্রয়াস হিসেবে দাবি করলেও, বাস্তবে মুসলিম সমাজের এক বৃহৎ অংশের…

waqf act protest bengal

ভারতের সংশোধিত ওয়াকফ আইন ২০২৪ বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে এসে দাঁড়িয়েছে। আইনটি নিজেকে ‘ধর্মীয় সম্পত্তিতে স্বচ্ছতা’ আনার প্রয়াস হিসেবে দাবি করলেও, বাস্তবে মুসলিম সমাজের এক বৃহৎ অংশের মধ্যে তৈরি হয়েছে ভয় ও ক্ষোভ। পশ্চিমবঙ্গের মতো ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল রাজ্যে এই আইন হয়ে উঠেছে এক বিস্ফোরক ইস্যু—যার ফলাফল এখন মৃত্যু, ধ্বংস আর রাজনৈতিক সংকট।

আইনটি নিয়ে আতঙ্ক কেন? waqf act protest bengal

ভারতে মুসলিমদের ধর্মীয় সম্পত্তি, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বহু শতাব্দীর ইতিহাস বহন করে। ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে থাকা এসব সম্পদ শুধু অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিক ও পরিচয়গতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পত্তির উপর ‘নিয়ন্ত্রণ’ বা ‘স্বচ্ছতা’র নামে প্রশাসনিক নজরদারি শুরু হলে, মুসলিম সমাজে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হবে, তা অনুমেয়।

কেন্দ্রীয় সরকার এই আইনের মাধ্যমে যেন এক অলিখিত বার্তা দিয়েছে—‘তোমাদের উপর আস্থা নেই, তাই আমরা দেখব কীভাবে তোমরা ধর্ম পালন করো।’ এটা নিছক আইন নয়, বরং ধর্মীয় আত্মমর্যাদায় হস্তক্ষেপ।

মুর্শিদাবাদ কেন উত্তপ্ত হল? waqf act protest bengal

মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা—এগুলো পশ্চিমবঙ্গের এমন জেলা যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এখানকার মানুষ ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার নিয়ে সচেতন। আইনটি এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একপ্রকার অস্তিত্ব সংকটের অনুভূতি তৈরি করেছে।

এই আতঙ্কই গড়ে তুলেছে বিক্ষোভের ঢেউ। কিন্তু শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ যেমন ছিল, তেমনি ছিল সুপরিকল্পিত সহিংসতা, যার মধ্যে পড়ে যায় সাধারণ মানুষ, নিরাপত্তা বাহিনী এবং রাজনৈতিক স্বার্থ।

রাজনীতি বনাম ধর্ম: কারা কীভাবে খেলল? waqf act protest bengal

তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) – মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যে এই আইন কার্যকর হবে না। এটি মুসলিম ভোটব্যাঙ্কের প্রতি একটি সরাসরি বার্তা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে—শুধু রাজনৈতিক অবস্থান নিলে হবে? সময়মতো গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়াটা বড় ব্যর্থতা।

বিজেপি- বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইলেও, তার সাম্প্রতিক মন্তব্য—যেখানে তিনি বলেছিলেন “২০২৬ সালে বিজেপি এলে মুসলিম বিধায়কদের বের করে দেওয়া হবে”—তা তাঁর ‘ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান’-কে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিজেপি একদিকে কেন্দ্রীয় আইন চাপিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে রাজ্যে বিভাজনের রাজনীতি চর্চা করছে।

কংগ্রেস ও অন্যান্য- রাশিদ আলভি-র মন্তব্য অনুযায়ী, আইনটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রণীত হয়েছে ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়াতে, যাতে নির্বাচনের আগে দেশের মেরুকরণ সহজ হয়।

সহিংসতা: প্রতিবাদ না পরিকল্পনা? waqf act protest bengal

বিক্ষোভকারীদের হাতে যদি পেট্রোল বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র থাকে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ছোড়া হয়, তাহলে এটা কেবল জনরোষ নয়—সাংগঠনিক সহিংসতার ইঙ্গিত। BSF-এর দাবি অনুযায়ী তারা rooftops থেকে গুলি খেয়েছে। আবার পুলিশের গুলিতে ১৬ বছরের কিশোরের মৃত্যু এবং এক পরিবারের দুই সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনা বলছে—প্রতিরোধও অতিক্রম করেছে সীমা।

প্রশাসনের ‘রেসপন্স নয়, রিঅ্যাকশন’ waqf act protest bengal

ঘটনা ঘটার পরেই ইন্টারনেট শাটডাউন, ১৬৩ ধারা জারি, গ্রেফতার, বাহিনী মোতায়েন ইত্যাদি পদক্ষেপ শুরু হয়। অথচ পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে প্রথম অবরোধ শুরু হওয়া থেকে মুর্শিদাবাদে আগুন লাগা পর্যন্ত পর্যাপ্ত সময় ছিল। সূত্র বলছে, রাজ্য গোয়েন্দা বিভাগ পূর্বাভাস দিয়েছিল, কিন্তু নেতৃত্বের মধ্যে ছিল গাফিলতি ও দ্বিধা।

সংবিধান বনাম রাজনৈতিক জেদ waqf act protest bengal

একটি আইন যদি সংসদে পাশ হয় এবং রাষ্ট্রপতির সই পায়, তাহলে কি কোনো রাজ্য তাকে কার্যকর করতে অস্বীকার করতে পারে? এখানেই শুরু হয় এক সাংবিধানিক টানাপোড়েন—যেটা কেন্দ্র বনাম রাজ্যের মধ্যে গভীর বিভাজন তৈরি করছে। আজ ওয়াকফ আইন, কাল অন্য ইস্যু—এই ধারাবাহিকতা ফেডারেল কাঠামোর ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তোলে।

ধর্মের নামে ধ্বংস নয় waqf act protest bengal

প্রতিবাদ গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু অস্ত্র, আগুন, হত্যাকাণ্ড—এসব দিয়ে ধর্মীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায় না। বরং এতে আদর্শ দুর্বল হয়, জনসমর্থন কমে এবং রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের সুযোগ বাড়ে।

 রাজনীতি যখন বিভাজনকে পুঁজি করে waqf act protest bengal

এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ এক সূক্ষ্ম এক মোড়ে দাঁড়িয়ে। একদিকে ধর্মীয় অধিকার নিয়ে আন্দোলন, অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের দ্বৈতনীতি—যেখানে একপক্ষ সংখ্যাগুরু আশঙ্কা উসকে দেয়, আরেকপক্ষ সংখ্যালঘু ভয়কে পুঁজি করে। এই ‘মিউচুয়াল পোলারাইজেশন’ রাজ্যকে পরিণত করছে ‘ম্যানুফ্যাকচারড ক্রাইসিস’-এর পরীক্ষাগারে।

প্রশ্ন এখন, পশ্চিমবঙ্গ কি তার অতীতের মত নীতিনির্ভর প্রতিরোধে ফিরে যাবে, নাকি ঝুঁকে পড়বে আবেগনির্ভর বিভাজনের রাজনীতিতে? উত্তর নির্ভর করছে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের উপর নয়—এই রাজ্যের মানুষের বিবেকের উপর।

 

Bengal: The amended Waqf Act 2024 has sparked protests and deadly violence in West Bengal. Muslim-majority districts like Murshidabad are tense. Fear, politics, and religious identity collide as India faces unrest over the controversial law.