মালদা: বয়স মাত্র ১২৷ এই ছোট্ট বয়সেই সংসারের গুরু দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়েছে তার৷ অসুস্থ বাবা, অসহায় মা আর ভাইদের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন জোগাতে গ্রামের পথে ঘুরে ঘুরে আইসক্রিম বেচছে ষষ্ঠ শ্রেণির মেধাবী ছাত্র দীপঙ্কর সাহা৷ দারিদ্রতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করেও অদম্য উৎসাহে চালিয়ে যাচ্ছে নিজের পড়াশোনা৷
সংসারের নিত্যদিনের টানাপোড়েনে বই-খাতায় মুখ লুকনো এই মেধাবী ছেলেকে বেঁছে নিতে হয়েছে ফেরিওয়ালার কাজ৷ পুরনো সাইকেলের পিছনে আইসক্রিমের বাক্স বেঁধে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেরায় সে৷ আইসক্রিম বিক্রি করে যে দুটো পয়সা জোটে, তা দিয়েই কোনও মতে চলে সংসার৷ সংসারে নিত্য অভাব লেগেই থাকে৷ কিন্তু অভাব তার মেধার পথে বাধা হতে পারেনি৷ বৈষ্ণবনগর ব্লকের জয়েনপুর হাইস্কুলের এই পড়ুয়া শেষ বার্ষিক পরীক্ষাতেও তৃতীয় স্থান অধিকার করেছিল।
লেখাপড়ার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চাতেও অদম্য উৎসাহ রয়েছে দীপঙ্করের৷ শিক্ষকদের অণুপ্রেরণায় অভিনয় করেছে রবি ঠাকুরের লেখা নাটকে। পরিবেশ নিয়েও বেশ সচেতন সে৷ বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষ সংরক্ষণেও সর্বদা এগিয়ে এসেছে এই মেধাবী পড়ুয়া৷ দীপঙ্করের এই কঠিন জীবন সংগ্রামের কাহিনী জানার পর তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন স্কুলের শিক্ষকরা৷ এই লড়াকু ছাত্রকে কুর্নিশ জানিয়ে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে বৈষ্ণবনগর থানার পুলিশ৷ তার পরিবারকে সবরকম সাহায্য করবেন বলে কথা দিয়েছেন তাঁরা৷
দীপঙ্কর যে আইসক্রিম বিক্রি করে সংসারের দায়িত্ব সামলে পড়াশোনা চালাত, তা প্রথমে জানতেন না স্কুলের শিক্ষকরা৷ প্রাণোচ্ছ্বল দীপঙ্করের হাসির আড়ালে যে এত লড়াই লুকিয়ে রয়েছে, দীর্ঘ দিন সে হদিশ পাননি তাঁরা৷ জয়েনপুর হাইস্কুলের শিক্ষক যুবরাজ ত্রিবেদী বলেন, ‘‘দীপঙ্কর প্রতিদিনই স্কুলে আসত৷ কিন্তু তাকে দেখে কোনও দিনই বোঝা যায়নি, ঘরে কী প্রচণ্ড দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে সে৷ যে দিন তার এই লড়াইয়ের কথা জানতে পারি, সেদিন চোখে জল চলে এসেছিল৷’’ স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা জানান, প্রতিদিন ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে উঠে সামান্য কিছু খেয়ে বাবার সাইকেল নিয়ে আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে ছোটে দীপঙ্কর। সেখান থেকে আইসক্রিম নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ফেরি করতে৷ গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফেরি করার পর বেলা ১০টায় বাড়ি ফেরে সে৷ এরপর স্নান সেরে, সামান্য কিছু মুখে দিয়ে চলে আসত স্কুলে। স্কুল থেকে ফিরে আবার শুরু হত তার সংগ্রাম৷ আইসক্রিম বিক্রি করে রাতে বাড়ি ফেরার পর সারা শরীরে নেমে আসত ক্লান্তি৷ কিন্তু সেই কষ্টকে উপেক্ষা করেই বসে পড়ত বই খাতা নিয়ে৷ বইয়ে পাতায় মুখ গুঁজে, তৈরি করে ফেলত যাবতীয় পড়া৷ এখন স্কুল বন্ধ থাকায়, আরও বেশি সময় ফেরি করতে পারছে সে।
দীপঙ্কর বলে, বাবা অসুস্থ৷ তাই আইসক্রিম বিক্রি করে আমাকেই সংসার চালাতে হয়৷ তবে শিক্ষকরা সব সময়েই সহযোগিতা করেন৷ তাঁদের সাহায্যে আমি অনেক দূর পড়াশোনা করতে চাই৷ রবি ঠাকুরের কবিতা, গান আর নাটক আমার খুব ভালোলাগে৷ ভালোলাগে গাছ লাগাতে৷ তবে তার একটাই আক্ষেপ৷ লকডাউনে বন্ধুরা অনলাইনে অনেকটা পড়াশোনা শিখে ফেলছে৷ সেখানে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে সে৷