প্রাণে বেঁচেও ওরা খাদের কিনারে : রক্ষা করবে কে?

কিংকর অধিকারী: শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার পিএইচডি পাঠরত বিনয় ঘোষাল বা কয়েক বছর আগে কলকাতার আবেশ দাশগুপ্তের মত কিশোর নয়, আমার আপনার সন্তানও যে নীরব ঘাতক এই অন্ধকার জগতের দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছে না তার গ্যারেন্টি কোথায়? আজ কেবল শহুরে এলাকায় নয়, প্রত্যন্ত গ্রামীন এলাকায়ও অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে মারণ সব নেশা। বন্ধুজগতও

প্রাণে বেঁচেও ওরা খাদের কিনারে : রক্ষা করবে কে?

প্রাণে বেঁচেও ওরা খাদের কিনারে : রক্ষা করবে কে?কিংকর অধিকারী: শুধু পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার পিএইচডি পাঠরত বিনয় ঘোষাল বা কয়েক বছর আগে কলকাতার আবেশ দাশগুপ্তের মত কিশোর নয়, আমার আপনার সন্তানও যে নীরব ঘাতক এই অন্ধকার জগতের দিকে একটু একটু করে এগোচ্ছে না তার গ্যারেন্টি কোথায়? আজ কেবল শহুরে এলাকায় নয়, প্রত্যন্ত গ্রামীন এলাকায়ও অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে মারণ সব নেশা। বন্ধুজগতও আজ আর নিরাপদ নয়।

পশ্চিম মেদিনীপুরের বেলদার কৃতি ছাত্র বিনয় জন্মদিনে বাড়ি এসেছিল। সন্ধের সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে যাওয়ার নাম করে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাত বারোটা বেজে গেলেও বাড়ি ফেরেনি। পরে তার নিথর দেহটির খোঁজ পাওয়া যায় রাস্তার ধারে। অনেকের নিশ্চিত অনুমান সারারাত ধরে বন্ধুদের সাথে অত্যধিক মদ্যপানেই এই নির্মম পরিনতি! সঠিক তদন্তে প্রকৃত কারণ উঠে আসবে হয়ত। একইভাবে কলকাতার বালিগঞ্জে কয়েক বছর আগে(২০১৬) আবেশ দাশগুপ্ত নামে তরতাজা এক স্কুলের ছেলে মদ খেয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ঢালু জায়গা দিয়ে পার্কিং লটের পাশে মাঠের দিকে এগোতে থাকে। এরপর ছোট একটি পাঁচিল টপকে মাঠের দিকে যেতে চায় আবেশ। তখনই ভারসাম্য হারিয়ে মাঠের দিকে পড়ে যায় এবং বোতলের কাচ ভেঙে আবেশের অক্সিলারি আর্টারিতে ঢুকে যায়। এরপর মাটিতে রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে সে। এমন পরিণতির কথা প্রকাশ্যে এলে শিহরিত হয়ে উঠেছেন সবাই। কিন্তু শুধু একজন বিনয় ঘোষাল বা আবেশ দাশগুপ্ত নয়, এমন লক্ষ হাজার তরতাজা ছেলেমেয়ে প্রতিদিন জীবন্ত লাশে পরিণত হচ্ছে। এর দায় কার? হাজার তদন্তের মধ্যে সেই আসল শত্রুদের নাম কি উঠে আসবে? তাৎক্ষণিক আনন্দে মাতিয়ে দেওয়া এবং ভবিষ্যতে হারিয়ে দেওয়া যে সমাজ পরিবেশ আমরা কিশোর- কিশোরী, যুবক- যুবতীদের জন্য আকৃষ্ট করে তুলছি তা থেকে কি এদের রক্ষা করা যাবে? শত শত মা বাবারা আজ বিনয় বা আবেশের নিথর দেহটা দেখে শিউরে উঠছে। কান্নায় ভেঙে পড়ছে পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয় সজন। কখনও কি ভেবেছেন, আপনার আমার সন্তানটিও হয়ত সবার অজান্তে এমন জগতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে!

যত দিন যাচ্ছে আজকের আধুনিক সমাজ কেবল টেকনোলজির দিক দিয়ে উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছে কিন্তু মানবিক গুণগুলি ধরে রাখা বা টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে আমাদের সমাজ অদ্ভুতভাবে উদাসীন। কেবল ভোগবাদী তাৎক্ষণিক আনন্দে গোটা সমাজটাকে মাতিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ছোট থেকেই যেগুলি স্বাভাবিকভাবে দেখতে দেখতে বড় হচ্ছে সেগুলি তারা চরিত্রের মধ্যে রপ্ত করছে। আজকের একটা ছোট্ট শিশু যখন দেখছে মদ্যপানের মতো সংস্কৃতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা সরকারি অনুমোদন রয়েছে তখন সেটা তার কাছে স্বাভাবিক। আপনার কাছে যা গ্রহণযোগ্য নয় বা প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি করে, ছোটদের কাছে তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। কৈশোর থেকে তাই সাবলীল ভাবেই বিভিন্ন নেশায় আসক্ত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। রক্ষা করার দায় যাঁদের তাঁরাই আজ তাদের ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে। একথা ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত সত্য যে, শাসন ক্ষমতায় যারা অধিষ্ঠিত থাকেন তারা কোনদিনই চায়না সে দেশের মানুষ মর্যাদার সাথে মানুষের মত মানুষ হয়ে মাথা তুলে বাঁচুক। তাই তারা সর্বদাই মানুষকে পশুর স্তরে নামিয়ে আনতে চায়। না হলে পশুর কাজ মানুষকে দিয়ে করানো যাবে না। ভোগবাদী স্থুল আনন্দে মাতিয়ে দিয়ে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে ওঠার রাস্তাটাকে মেরে ফেলতে চায়। সুকৌশলে নিজেদের শাসন শোষণের দিনগুলিকে আরো বাড়িয়ে নেওয়াই তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য। আমরা যদি এই সত্য উপলব্ধি করতে না পারি এবং সচেতনভাবে শাসকের এই ছোবল থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিতে না পারি তাহলে হাজার কসরত করেও আমাদের সন্তানদের রক্ষা করতে পারবো না।

এমন একটা সমাজের মধ্যে আমরা রয়েছি যেখানে আগামী প্রজন্মের কিশোর-কিশোরীদের কাছে নেই কোন আদর্শ চরিত্র, নেই অনুকরণ করবার মতো নেতা, নেই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব, পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কটা হয়ে গিয়েছে যান্ত্রিক। ফলে একজন কিশোর বা কিশোরী এই সমাজ থেকে অনুকরণ বা অনুসরণ করবার মত তেমন কোনো চরিত্র পাচ্ছে না। বাবা-মা চাইলেই তাদের সন্তানদের মনের মত মানুষ করে তুলতে পারছে না। ছোটো থেকেই আমরাই তো তাদের শিখিয়েছি “আপনি বাঁচলে বাপের নাম”, “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা”, “নিজেরটা গুছিয়ে নে”, “সাতে পাঁচে থাকার দরকার নেই” ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর যদি আমাদের ছেলেটা বা মেয়েটা বখে যায়, নষ্ট হয়ে যায় বা বাবা মাকে ফেলে দিয়ে নিজের স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে দূরে সরে যায় তখন সব দোষ কি তাদের? প্রাণে বেঁচে গেলেও কি তাদের রক্ষা করা গেল? সারা জীবন সন্তানের জন্য কালাতিপাত পরিশ্রম করার পর পরিণত বয়সে সেই সন্তানের কাছে দায়-দায়িত্ব-কর্তব্যবোধ আশা করাটাই অবান্তর হয়ে যায়!

শুধু কি পিতামাতা, পরিবার পরিজন? বিদ্যালয়গুলিতেও তেমন শিক্ষক কয়জন আছেন যাঁরা ছাত্র-ছাত্রীদের মাথায় হাত দিয়ে আশির্বাদ করে বলেন, শুধু অর্থ রোজগারের জন্য নয়, পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হও। মদ-জুয়া-সাট্টা-অশ্লিল ছবি প্রদর্শনের সমস্ত রকমের ঢালাও ব্যবস্থা রেখে বিনয় বা আবেশদের মানুষ করা যাবে কি? এ সমস্ত ব্যবস্থা সাজিয়ে রেখে যতই তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করি না কেন, প্রাণে বেঁচে গেলেও তাদের রক্ষা করা যাবে না। শাসককুল কোনদিনই এ দায়িত্ব গ্রহণ করবে না। এ সত্যটা উপলব্ধি করে সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে সে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে আমজনতাকেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − 7 =