সমুদ্র গিলছে ভিটে, ঘূর্ণিঝড়ে উড়েছে ছাদ, করোনা কেড়েছে জীবিকা, কাঁদছে সুন্দরবন

সমুদ্র গিলছে ভিটে, ঘূর্ণিঝড়ে উড়েছে ছাদ, করোনা কেড়েছে জীবিকা, কাঁদছে সুন্দরবন

 
বিশ্বজিৎ পাল, ক্যানিং: সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দাদের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ওখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা যেমন প্রকৃতি নির্ভর, ঠিক তেমনই তাদের বিপদের কারণও সেই প্রকৃতি। একের পর এক ঝড়, সাইক্লোন আসে এবং অসহায় মানুষদের ভিটেমাটি ছাড়া হয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপের ৫০ লক্ষ বাসিন্দা তাই স্থায়ী হয়েও স্থায়ী হতে পারে না।

ভারত ভূ-খণ্ডের সুন্দরবনের ১০২টি দ্বীপের মধ্যে ৪৮টি দ্বীপ এখনও শুধুই বনাঞ্চল। সেখানে জনবসতি নেই। বাকি ৫৪টি দ্বীপের জঙ্গল সাফ করে গড়ে উঠেছে মনুষ্য প্রজাতির বসবাস। ৩,৫০০ কিলোমিটার প্রশস্ত নদী বাঁধ সুন্দরবনকে ঘিরে রেখেছে। এই নদী বাঁধই এখানকার মানুষের বড় ভরসা বন্যার হাত থেকে বাঁচতে। তবু মাঝেমধ্যেই ভয়াবহ সাইক্লোন এসে সব ওলটপালট করে দিয়ে যায়। ১৮৬৭ সালে ভীষণ ঘূর্ণিঝড়ে সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে ছিল সুন্দরবনের। সেই সময় মাতলা নদীতে ডুবে গিয়েছিল জাহাজ। ধ্বংস হয়ে গিয়ে ছিল ক্যানিং বন্দর।

২০০৯ সালের আয়লা, ২০১৯ সালে বুলবুল এবং সবশেষে সুপার সাইক্লোন আমফানের প্রকোপে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে সুন্দরবন। এখন অবশ্য সুন্দরবন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ব-দ্বীপ অঞ্চলটি। তবু শান্তি নেই। এই কৌশিকি অমাবস্যায় জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হয়েছে সুন্দরবনের বিস্তৃত অঞ্চল। বাঁধ ছাপিয়ে নদীর নোনা জল ঢুকে জলমগ্ন হয়ে পড়েছে লোকালয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চাষের জমি, পুকুরের মাছ চাষ। এক দিকে জলোচ্ছ্বাস, অন্যদিকে নিম্নচাপ এবং টানা বৃষ্টিতে নাজেহাল সুন্দরবনবাসী। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাগর, নামখানা, কাকদ্বীপ, পাথর প্রতিমা, ক্যানিং-১ ও ২,বাসন্তী,গোসাবা সহ বিভিন্ন ব্লকের বিভিন্ন অঞ্চল। একাধিক জায়গায় বাঁধ ভেঙে নোনা জলে প্লাবিত বসতবাড়ি।

সাগর ব্লকের গঙ্গাসাগর গ্রাম পঞ্চায়েতের মহিষমারি গ্রাম। এখানকার চার হাজার মানুষের আশঙ্কা সেই নদী বাঁধ। আয়লার পর বাঁধ নির্মাণ শুরু হলেও যে পর্যন্ত হওয়ার কথা ততটা হয়নি। মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার হয়েছে নদী বাঁধ। হওয়ার কথা ছিল লাইট হাউস থেকে মহিষামাড়ি হাতিপিটিয়া পর্যন্ত, হয়েছে বেগুয়াখালি পর্যন্ত। যার ফলে শতাধিক পরিবার নোনা জলে প্লাবিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে। একাধিক ঘূর্ণিঝড়ের সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মহিষামারি গ্রামের পশ্চিমপাড়া।

পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মৎস্যজীবী দিবস মাইতি স্ত্রী-পুত্র নিয়ে কোনও মতে দিন চালান। কোটালের নোনা জলে ভেঙেছে তাঁর মাটির দেওয়াল। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে বাস করলেও সরকারি সুযোগ সুবিধা পাননি। কোটালের নোনা জলে ডুবে গেছিল তার বাড়ি। জল নামার পর কাঁদা প্যাঁচপ্যাঁচে অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। বাঁধ পরিদর্শনে আসলেও দিবস মাইতির বাড়িতে আসেননি কোনও আমলা বা প্রশাসনের প্রতিনিধি। হতদরিদ্র মানুষটির এখন ইশ্বরই ভরসা। এদিকে সরকারি নির্দেশে গভীর সমুদ্রে ও নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া এখন নিষেধ। দিবস মাইতির মতো কয়েক হাজার মৎস্যজীবী ঘরবন্দি। একদিকে করোনা ভাইরাস, অপরদিকে লকডাউন এবং সর্বোপরি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ত্রিমুখী ছোঁবলে বিপর্যস্ত অবস্থায় তাঁরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *