শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা তপন রায়চৌধুরীর প্রয়াণে শোকার্ত শিক্ষক সমাজ

শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা তপন রায়চৌধুরীর প্রয়াণে শোকার্ত শিক্ষক সমাজ

 

কলকাতা: লড়াই করে বাঁচতে চেয়েছিলেন এবং লড়াই করেই বেঁচেছিলেন তিনি। অবশেষে ইহজীবনের মতো লড়াই সাঙ্গ হল তাঁর। প্রয়াত হলেন মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের এক অবিসম্বাদী নেতা তপন রায়চৌধুরী। ৭৮ বছর বয়সে ক্যালকাটা হার্ট রিসার্চ ক্লিনিক অ্যান্ড হসপিটালে ফুসফুসের ক্যানসারজনিত রোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। মঙ্গলবার দুপুর ২টো নাগাদ মৃত্যু হয় তাঁর।

গত শতকের আটের দশকের একদম গোড়ার দিকে ভাষা-শিক্ষা, বিদ্যালয়ের স্বাধিকার এবং শিক্ষক- শিক্ষকর্মীদের ৬০-৬৫ আন্দোলনে ছিলেন অন্যতম পুরোধা ছিলেন তপনবাবু। যতদিন সুস্থ ছিলেন, বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ আন্দোলনে। বহু ঐতিহাসিক আন্দোলনেই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তপন। একজন সত্যিকারের হৃদয়বান বন্ধুবৎসল ছাত্র দরদী শিক্ষক ছিলেন।

দলমত নির্বিশেষে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাঁকে আপনজন বলে মনে করতেন। তাঁর প্রয়াণ রাজ্যের শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনে এক অপূরণীয় শূন্যতার সৃষ্টি করল৷ তাঁর প্রয়ানে গভীর শোকপ্রকাশ করেছেন মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ মিত্র, বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হান্ডা৷ শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তাঁরা৷

অধ্যাপক সংহতি মঞ্চের আহ্বায়ক মানস জানা জানিয়েছেন, ‘‘তপন রায়চৌধুরী ছিলেন শিক্ষা আন্দোলনের এক সুপরিচিত নেতৃত্ব। ভাষা- শিক্ষা আন্দোলন, পাশ-ফেল চালুর দাবিতে আন্দোলনে তিনি  ছিলেন সামনের সারির নেতা। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সর্বস্তরের শিক্ষকদের সমস্যা নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনে দীর্ঘদিন তিনি পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন। বহুমুখী আন্দোলন পরিচালনার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শিক্ষক সংগঠনগুলিকে উপযুক্ত সময়ে সঠিকভাবে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের দিশা দেখিয়ে গেছেন তিনি। অধ্যাপক আন্দোলনে  তাঁর পরামর্শ এবং সুচিন্তিত মতামত আমাদের বহু সময় পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে সাহায্য করেছে। শুধু শিক্ষা বা শিক্ষক আন্দোলন নয়, জনজীবনের নানা সমস্যা নিয়ে আন্দোলনে তাঁকে নেতৃত্বের ভূমিকায় দেখে শিক্ষকরা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। উচ্চ সংস্কৃতি এবং আদর্শের সংমিশ্রণ তাঁর কথায়, বক্তব্যে, আলাপচারিতায় এমনভাবে প্রতিফলিত হতো, যে কোনো শিক্ষক তাঁর সান্নিধ্যলাভ করতে আকৃষ্ট হতেন। আজকের দিনের অধঃপতিত বুর্জোয়া ব্যক্তিবাদ, আত্মকেন্দ্রিকতা মুক্ত উন্নত মানুষ হওয়ার সংগ্রাম পরিচালনায় শিক্ষক সমাজের কাছে শ্রী তপন রায়চৌধুরী একটি দৃষ্টান্ত। বর্তমান সরকারের জনস্বার্থবিরোধী শিক্ষানীতিগুলির প্রতিবাদে আন্দোলনে আমরা ভীষণভাবে তাঁর অভাব অনুভব করবো। আমরা আমাদের একজন যথার্থ অভিভাবককে হারালাম। অধ্যাপক সংহতি মঞ্চের পক্ষ থেকে তাঁর প্রয়াণে আমরা গভীর শোক প্রকাশ করছি।’’

সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক অধ্যাপক তরুণকান্তি নস্কর বলেন, ‘‘শিক্ষক ও শিক্ষা আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা, রাজ্যের সেভ এডুকেশন আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা, মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতির প্রাক্তন সম্পাদক ও সভাপতি, বুদ্ধিজীবী মঞ্চের প্রতিষ্ঠাতা সহ সভাপতি শ্রী তপন রায়চৌধুরী আজ দুপুর ১.৫৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। তিনি ফুসফুসের ক্যান্সার ও করোনায় আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন ক্যালকাটা হার্টক্লিনিক এণ্ড হসপিটালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তিনি ইংরেজি ও পাশ ফেল তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে রাজ্যে যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে নেতৃত্বকারী ভূমিকা পালন করেছিলেন। নন্দিগ্রাম, সিঙ্গুরে কৃষিজমি রক্ষার জন্য যে দীর্ঘ বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল এবং তার সমর্থনে রাজ্যের বুদ্ধিজীবীদের নেতৃত্বে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল সেখানে তিনি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে এরাজ্যের শিক্ষা, শিক্ষক আন্দোলন থেকে শুরু করে নানা স্তরের গণ আন্দোলনের প্রভূত ক্ষতি হল। সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটি তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছে।’’

বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হান্ডা বলেন, ‘‘শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা তপন রায় চৌধুরীর প্রয়াণে শিক্ষা আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হল।সমিতির পক্ষ থেকে আমরা গভীর শোকজ্ঞাপন করছি এবং তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।’’ এছাড়া, প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন পর্ষদের সাধারণ সম্পাদক তপন সামন্ত, শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মঞ্চের পক্ষে মিরাতুন নাহার, অল বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের রাজ্য সম্পাদক গৌতম মাইতি-সহ অন্যান্য অনেক শিক্ষা বিষয়ক সংগঠনের পক্ষ থেকে শোক জ্ঞাপন করা হয়েছে৷

শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষানুরাগী ঐক্যমঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘‘শিক্ষা আন্দোলনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তিত্ব ছিলেন মাননীয় তপন রায়চৌধুরী। তাঁর মৃত্যুতে শিক্ষা জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। আমরা গভীরভাবে মর্মাহত এবং শোক প্রকাশ করছি।’’ এসটিইএ’র দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সম্পাদক অনিমেষ হালদার বলেন, “তিনি আমাদের মত নবীনদের খুব স্নেহ করতেন। আমার বাবারও নেতা ছিলেন তিনি। বহু পরিবারের অভিভাবক ছিলেন শ্রী তপন রায়চৌধুরী।  শিক্ষা ও শিক্ষক আন্দোলনে প্রতিটি মুহূর্তে তাঁর শুন্যতা অনুভব করবো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × one =