জন ধনের জোয়ারে কুপোকাত লকডাউন, শিকেয় সোশ্যাল ডিস্টেনসিং

জন ধনের জোয়ারে কুপোকাত লকডাউন, শিকেয় সোশ্যাল ডিস্টেনসিং

মৌমিতা বিশ্বাস: করোনা পরিস্থিতিতে টানা ২১ দিনের লকডাউনে অনেকটাই বিপর্যস্ত আমআদমি৷ ধুঁকতে শুরু করেছে তামাম বিশ্বের অর্থনীতি৷ ভারতেও অর্থনীতির সূচক ক্রমেই নিম্নগামী হচ্ছে৷ চরম সংকটে পড়েছেন দেশের কোটি কোটি মানুষ৷ বন্ধ হয়েছে রুজি রোজগার৷ একমুঠো খাবার জোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাঁদের৷

এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে একগুচ্ছ আর্থিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ এর মধ্যে মহিলাদের জন ধন প্রকল্পের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে তিন মাসের জন্য ১৫০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে৷ এপ্রিলের ২ তারিখ থেকেই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে সেই টাকা ঢুকতেও শুরু করেছে৷ আবার উজ্জ্বলা প্রকল্পে তিনমাসে তিনটি গ্যাস দেওয়া হবে বিনামূল্যে। সিলিন্ডারের দাম বাবদ সেই টাকাও ঢুকছে ব্যাংক অ্যকাউন্টে৷

কিন্তু যেদিন থেকে প্রকল্পের ঘোষণা হয়েছে, দেখা গিয়েছে তার পর দিন থেকেই দলে দলে মানুষ ভীড় জমাতে শুরু করেছেন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায়৷ শুধুমাত্র কবে টাকা পাবেন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে৷ পরিকল্পনা মাফিক টাকা দেওয়া শুরু হয় নির্দিষ্ট দিন থেকে৷ আর সেই দিন থেকেই শিকেয় ওঠেছে লকডাউন৷ 

দু’মুঠো অন্ন জোগাড়ের তাগিদে সকাল থেকেই ব্যাংকের সামনে শুরু হচ্ছে লম্বা লাইন৷ সেখানে ‘সোশ্যাল ডিস্টেনসিং’? নৈব নৈব চ৷ এ সব নিয়ে চিন্তা করার সময় নেই হতদরিদ্র মানুষগুলোর৷ তাঁদের হাতে ৫০০ টাকা আসছে, এটাই বড় কথা৷ রোগ বালাই নিয়ে ভাববার সময় কোথায়!  

অথচ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রুখতে এই ‘সোশ্যাল ডিস্টেনসিং’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’ তৈরি করতেই ২৪ তারিখ থেকে দেশজুড়ে চলছে লকডাউন৷ বুধবার ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সর্বদলীয় বৈঠকে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ দেশজুড়ে আরও বৃহত্তরভাবে শুরু হয়েছে টেস্টিং৷ বারবার করে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে৷ বলা হচ্ছে ঘরে থাকুন৷ বাইরে বেরলেও দূরত্ব বাজায় রাখতে হবে৷ কিন্তু সেই নিয়ম মানা হচ্ছে কোথায়? 

এই মুহূর্তে ব্যাংকের দিকে তাকালে সোশ্যাল ডিস্টেনসিং শব্দটাই হাস্যকর হয়ে ওঠে৷ সকাল থেকে ব্যাংকগুলির সামনে লাইন করে দাঁড়ানো মহিলারা সকলেই প্রায় একে অপরের ঘাড়ে উঠে পড়েছেন৷ ন্যূনতম দূরত্বটাও নেই তাঁদের মাঝে৷ এরই মাঝে কে আগে এসেছেন, বা কে আগে দাঁড়িয়েছেন, তা নিয়ে চলছে ঝগড়া অশান্তি৷ অনেকে আবার কাটফাটা রোদে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত অবসন্ন৷ একটু ছায়ার খোঁজ করে শুয়ে পড়ছেন রাস্তার ধারের কোনও ধাপিতে৷ অথচ এই ভীড় নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থাই চোখে পড়ছে না৷ ভীড়ের মাঝে পুলিশের টিকি মেলা ভার৷ মাঝে মাঝে দেখা মিললেও, তারপর পরিস্থিতি যে কে সেই৷ ব্যাংকগুলির তরফেও কোনও পদক্ষেপ করা হচ্ছে না৷ সচেতনতার এতটাই অভাব যে, হাজার হাজার মহিলা যে যেমন পারছেন, তেমন ভাবেই একে অপরের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ছেন৷ 

কলকাতায় বাজারে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে লক্ষণরেখা টেনে দিয়ে এসেছিলেন৷ কতটা দূরত্ব মেনে চলতে হবে, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ছবি এঁকে৷ তার দেখানো পথে বিভিন্ন শহরেও মানুষ এমন ভাবেই লক্ষণরেখা টেনে দূরত্ব বাজায় রেখেই দোকান বাজার করছিলেন৷ কিন্তু সব লক্ষণরেখা ঘুঁচিয়ে দিল জন ধন অ্যাকাউন্টের ৫০০ টাকা৷ দরিদ্র অসহায় মানুষগুলোকে দোষ দেওয়া যায় না৷ পরিবারের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ৫০০ টাকার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা৷ এই টাকা তাঁদের কাছে আশীর্বাদ৷ এই আশীর্বাদই অভিশাপ হয়ে সমাজকে গ্রাস করবে না তো? এই প্রশ্নটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে৷ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

five × 4 =