কলকাতা: রাজ্যে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত দীর্ঘ দিন ধরে চলছে। গরু পাচার হোক, কয়লা পাচার হোক কিংবা নিয়োগ বা হালে রেশন দুর্নীতি, সবকটি ইস্যুতে একটি ‘কমন’ ব্যাপার আছেই। তা হল ডায়েরি উদ্ধার হওয়া। কোনও সময় লাল ডায়েরি, কোনও সময়ে বাদামি, এই ডায়েরি নিয়ে গোয়েন্দারা তো বটেই সাধারণ মানুষ সবসময়ই উৎসুক থেকেছেন। কী তথ্য মিলল ডায়েরি থেকে, কার নাম পাওয়া গেল, সব নিয়েই কৌতূহল থাকে। অতীত থেকে বর্তমানে একাধিক ঘটনায় তাই ডায়েরি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
দেশের মধ্যে ডায়েরি নিয়ে প্রথম তোলপাড় হয়েছিল বলা যায় নব্বইয়ের দশকে, হাওয়ালা অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি ইস্যুতে। সুরেন্দ্র জৈনের ‘রহস্যময় ডায়েরি’ নিয়ে কার্যত শোরগোল পড়েছিল। ওই ডায়েরিতে দেশের তাবড় রাজনৈতিক নেতাদের নাম কোড হিসাবে লেখা হয়েছিল বলে জানা যায়। পরবর্তী সময়ে ২০১৭-১৮ সালে সাহারা কর্তা সুব্রত রায়ের ডায়েরি নিয়েও রহস্য দাঁনা বেধেছিল। তবে ডায়েরি নিয়ে বিশ্লেষণ পশ্চিমবাংলাতেও কম করতে হয়নি। তার উদাহরণ আছে বহু।
সারদার ডায়েরি
বাংলায় ডায়েরি রহস্য শুরু হয়েছিল বলা যায় সারদা মামলা থেকেই। সেই চিটফান্ড কেলেঙ্কারি মামলায় ‘লাল’ ডায়েরির কথা শোনা গিয়েছিল। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা দাবি করেছিলেন, সারদা-কর্তা সুদীপ্ত সেনের অফিস ঘরের সামনে ওই ডায়েরি রাখা থাকত। কাউকে কোনও অর্থ দিলে তাঁর নাম ও টাকার পরিমান ওই ডায়েরিতে লেখা হত। তবে ৮ ট্রাঙ্ক ভর্তি সারদার নথি সিবিআই দফতরে জমা থাকলেও এখনও পর্যন্ত সারদার ওই লাল ডায়েরি এবং পেন ড্রাইভের সন্ধান মেলেনি বলে সিবিআই সূত্রে খবর। সারদা কেলেঙ্কারির তদন্তে বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে এই লাল ডায়রি প্রসঙ্গ। কিন্তু কোথায় সেই লাল ডায়েরি? জানা নেই কারোর।
বিনয় মিশ্রর ডায়েরি
কয়লা এবং গরু পাচার মামলার তদন্তেও এক ডায়েরি নিয়ে জলঘোলা হয়েছে। বিনয় মিশ্র মামলায় উঠে এসেছিল সেই ডায়েরি প্রসঙ্গ। তবে এই ডায়েরি লাল না নীল কোন রঙের তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি সিবিআই আধিকারিকরা। শুধু জানা গিয়েছে, সেই ডায়েরিতে নাকি একাধিক প্রভাবশালীর নাম রয়েছে। এই নাম সামনে চলে এলে গোটা তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ হতে পারে কারণ কেলেঙ্কারির পর্দাফাঁস হবে। কিন্তু আপাতত সেই ডায়েরি নিয়েও কোনও নতুন তথ্য নেই।
অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ডায়েরি
এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার হওয়া পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে অর্থ ছাড়াও বহু জিনিস উদ্ধার করেছিল ইডি। তার মধ্যে ছিল বিশেষ একটি জিনিস। হ্যাঁ, ঠিকই ভাবছেন, একটি ডায়েরি। জানা যায় অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে কালো ডায়েরি ও একটি পকেট ডায়েরি উদ্ধার করেছিল ইডি। সেই ডায়েরিতেও একাধিক তথ্য থাকার সম্ভাবনা প্রবল, যা নিয়োগ তদন্তের গতি বহুগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে।
রেশন দুর্নীতির ডায়েরি
হালে রাজ্যর বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক গ্রেফতার হয়েছেন রেশন দুর্নীতি ইস্যুতে। তাঁর আপ্তসহায়ক অমিত দে’র বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে ইডি এবং সেখান থেকে মেরুন রঙের একটি ডায়েরি উদ্ধার হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। ইডির তরফে দাবি করা হয়েছে, ওই ডায়েরিতে রেশন বন্টনের আর্থিক লেনদেনের হিসেব রাখা হত। কোটি কোটি টাকা আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে ওই ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে বলেও দাবি গোয়েন্দাদের। এমনকি ইডি এও জানিয়েছে, ডায়েরিতে ‘বালু দার হিসেব’ বলে উল্লেখ রয়েছে। ২০২০ এবং ২০২১ সালের করোনার সময় কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া রেশন চাল ও গম অন্যান্য সামগ্রিক খোলা বাজারে বিক্রির অভিযোগ এনেছে ইডি।
কিন্তু দুর্নীতির সঙ্গে ডায়েরির এই সম্পর্ক কীসের? বিশেষজ্ঞদের মতে, অধিকাংশ মানুষ অনেক কিছু একসঙ্গে মনে রাখতে পারে না। আর আর্থিক দুর্নীতির বিষয় হলে তো প্রচুর হিসেব রাখতে হয়। তাই ডায়েরি সবথেকে সহজ উপায় সবকিছু মনে রাখার জন্য। প্রতিদিনের হিসেব, কাদের সঙ্গে কত লেনদেন, এই সমস্ত হিসেব ডায়েরিতে লিখে রাখলে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সেই ডায়েরিই অবশ্য পরে বড় ‘হাতিয়ার’ হয়ে যায় গোয়েন্দাদের।