কলকাতা: পুরুলিয়ায় রেশন কার্ড বন্ধক রাখার বিনিময়ে ঋণের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই সমালোচনার ঝড় উঠেছে রাজ্য রাজনীতিতে৷ ঘটনার কড়া সমালোচনা করেন বামফ্রন্ট নেতা সূর্যকান্ত মিশ্র৷ তিনি বলেন, এই সমস্যা শুধুমাত্র একটি জায়গার নয়। প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়েই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় এমন ঘটনা ঘটে চলেছে৷
সূর্যকান্ত জানান, সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমান জেলার এক ডিলার কবুল করেছেন যে, শাসকদলের এক পঞ্চায়েত কর্মাধ্যক্ষকে ব্যবসা চালানোর জন্য দশ হাজার টাকা মাসোহারা দিতে হয় তাঁকে। এবার হিসেবে করে দেখুন জেলায় কতজন ডিলার আছেন এবং তাঁদের থেকে ১২ মাসে মোট টাকা মাসোহারা পান এই নেতারা৷ তিনি আরও বলেন, কৃষক আন্দোলনের জেরে অবশ্য কিছুটা চাপে পড়েছে এই চক্র৷ থানার অফিসারও সুরক্ষা দিতে চাইছেন না। কিন্তু সমস্যা হল যাঁরা ওই এলাকায় বন্ধকের ব্যবসা করেন, তাঁরাও আর সোনাদানাও বন্ধক নিতে পারছেন না। কারণ বন্ধক নিতে নিতে আপাতত তাঁদের হাতে পুঁজি নেই। এটাই সংকটের আসল চেহারা।
সম্প্রতি এবিপি আনন্দের একটি খবর গোটা রাজ্যের মানুষকে নাড়া দিয়ে যায়৷ নড়েচড়ে বসে প্রশাসন৷ সোনাদানা বা জমি নয়, রেশকার্ড বন্ধক রেখে ঋণ দেওয়া ঘটনা উঠে আসে পুরুলিয়ার ঝালদার সরজুমাতু গ্রামে৷ এখানকার ১৪টি পরিবার মহাজনের কাছে রেশন কার্ড বন্ধক রেখেছিল৷ বেশ কিছু বছর ধরেই অলক্ষ্যে চলছিল এই বেআইনি কারবার৷ কিন্তু লকডাউনের জেরে ঘটনার পর্দা ফাঁস হয়ে গিয়েছে৷ জানা গিয়েছে, গ্রামের ওই ১৪টি পরিবারের সদস্যরা পরিযায়ী শ্রমিক৷ বিভিন্ন জেলায় মূলত ইঁটভাটা, পাথর খাদানে কাজ করেন তাঁরা৷ অভিযোগ, আর্থিক অনটন মেটাতে মহাজনদের দ্বারস্থ হলে সুযোগ নেনে তাঁরা৷ শ্রমিক পরিবারগুলির রেশনকার্ড বন্ধক রেখে টাকা ধার দেন মহাজনরা৷
রাধা কালিন্দী নামে ঝালদার এক পরিযায়ী শ্রমিক বলেন, ‘‘শরীর খারাপের জন্য টাকার প্রয়োজন ছিল৷ তাই কার্ড বন্ধক দিয়েছিলাম৷ কিন্তু এখন সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে৷ রেশনও পাচ্ছি না৷ সন্তোষ মাহাতো নামে এক মহাজনের কাছে কার্ড বন্ধক রয়েছে৷ রেশন কার্ডের বিনিময়ে তিনি ১০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন আমাকে৷’’ এটা সাম্প্রতিক ঘটনা নয়৷ বহু দিন ধরেই চলছিল এই কারবার৷ কিন্তু লকডাউনে পরিস্থিতির চাকা ঘুরে গিয়েছে৷ রেশন কার্ড হাতে না পেয়ে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে পরিবারগুলির৷
ভাগীরথি কালিন্দী নামে অপর এক পরিযায়ী শ্রমিক বলেন, ‘‘ওনারা আমাদের কার্ড দিতে চাইছেন না৷ পেটের জ্বালায় জ্বলছি আমরা৷ রান্নাবান্না বন্ধ৷ লোকের বাড়ি থেকে খাবার চেয়ে এসেছি৷ বাচ্চারাও না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে৷’ বছরের পর বছর ধরে গরিব পরিবারগুলির রেশন কার্ড যে তাঁদের হফাজতে রয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন মহাজনরা৷ গুণধর কুইরি নামে এক মহাজন বলেন, চার বছর ধরে আমার কাছে দুটো কার্ড বন্ধক রয়েছে৷ একটি কার্ডে এক কিলো এবং অন্য কার্ডটিতে ৯ কিলো রেশন পাই৷ ২২ হাজার টাকার বিনিময়ে কার্ড বন্ধক রেখেছি৷’’ এদিকে, মহাজনরা যে অন্যের কার্ড দেখিয়ে রেশন নিয়ে যান তা বিলক্ষণ জানানে রেশন ডিলাররাও৷ এই চক্রের কথা ফাঁস করে দেন অমলেশ মাহাতো নামে এক রেশন ডিলার৷
এতদিন এই ভাবেই চলছিল৷ কিন্তু পেটে টান পড়ার পরই ঝালদা এক নম্বর ব্লকের বিডিও’র কাছে অভিযোগ জানান ওই ১৪টি পরিবার৷ শোরগোল পড়ে যায় প্রশাসনে৷ মহাজানদের কাছ থেকে কার্ড নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয় ১৪টি পরিবারের হাতে৷ পুরুলিয়ার জেলা শাসক রাহুল মজুমদার বলেন, যিনি বন্ধক রেখেছেন এবং যিনি বন্ধক নিয়েছেন, তাঁরা উভয়েই সমান অপরাধী৷ নিজের কার্ড অন্য কাউকে দেওয়া যায় না৷ ব্লক প্রশাসন দুই পক্ষকেই ডেকে কড়া ভাবে তা বুঝিয়ে দিয়েছে৷ দ্বিতীয়বার এই কাজ হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে৷ আপাতত নিজেদের রেশনকার্ড ফিরে পেয়েছে ওই ১৪টি পরিবার৷ মুখে অন্ন উঠতে তাঁদের৷