নাগরিকত্ব প্রমাণে সারা রাত লাইনে দাঁড়ালেন ১০ হাজার দিশেহারা জনতা

নাগরিকত্ব প্রমাণে সারা রাত লাইনে দাঁড়ালেন ১০ হাজার দিশেহারা জনতা

তেহট্ট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৯ দিনটা, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের ইতিহাসে কোনদিক থেকে ঠিক কতটা গুরুত্বপূর্ণ হবে তা তো সময়ই বলে দেবে৷ ওই দিন আই হিসেবে মান্যতা পেয়েছে চূড়ান্ত বিতর্কিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল৷ পার্লামেন্টে বিলের পক্ষে ৩১১ আর বিপক্ষে ৮০ রাজ্যসভায় ক্ষমতাসীন বিজেপি ও বিরোধীদলগুলোর মধ্যে জোর বিতর্কের পর পক্ষে ১২৫টি এবং বিপক্ষে ভোট পড়ে ১০৫টি৷ অর্থাৎ সংসদীয় আইন মেনে মাত্র দু-তিনশো মানুষের বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে দেশের ১৩৭কোটি মানুষের নাগরিকত্ব এখন বড়সড় প্রশ্নের সম্মুখীন৷ তাইতো এদেশের নাগরিক হিসেবে নতুন করে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ৷

যদিও তার জন্য ঠিক কি কি প্রয়োজন সেই ধারণাই নেই৷ তবু মোদি সরকারের আনা আইন যখন, তখন তারই পরিকল্পিত আধার কার্ডকেই আপাতত পরম ভরসা বলে মনে করছেন অনেকেই৷  তাইতো বছরের প্রথম রাতে কনকনে ঠাণ্ডা উপেক্ষা করেও আধার কার্ড সংশোধনের জন্য রাতভর লাইনে দাঁড়িয়ে রইলেন অন্তত ১১ হাজার মানুষ৷ এরমধ্যে বেশিরভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়৷ নতুন বছরে শুরুতেই এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা আশা করেননি খোদ ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষও৷ কিন্তু এত মানুষের আঁধার সংশোধন, তাও একদিনে? 

ভিড় সামলাতে বাইরে রীতিমতো পুলিশ মোতায়েন করতে হয়৷ ভিতরে ব্যাঙ্ক কর্মীরাও হাঁপিয়ে গিয়ে শেষপর্যন্ত নিজেরাই কুপন সিস্টেম করে দিয়েছেন৷ কিন্তু ওইদিন সবার ভাগ্যে আবার কুপনটাও জোটেনি৷ তবে যারা সৌভাগ্যক্রমে কুপন পেয়েছেন তাদের তো চোখ কপালে৷ কারণ ওই কুপন নম্বরে অনেকেরই আধার সংশোধনের তারিখ পড়েছে ২০২১ সালে৷ এরপর এখনও প্রায় ৫ হাজার মানুষকে কুপন দেওয়া বাকি৷ তাদের আধার সংশোধন করাতে ২০২২ সাল হয়ে যাবে৷ তাঁরা তো রীতিমত দিশেহারা৷ নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতা ও পক্ষপাতিত্বের টানাপোড়েনে সাধারণ মানুষের দুর্দশার নজির তৈরি হচ্ছে৷ দেশজুড়ে একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে৷ এর মধ্যেই নাগরিকত্ব হারানোর আশঙ্কায় আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকটি৷ সাধ্যমত নথি জোগাড় করতে এখন নাওয়া-খাওয়া ভুলেছে মানুষ৷ তাই তেহট্টর চিত্র এখন বহু জায়গায় চোখে পড়ছে৷

আচ্ছা, যখন এরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলছেন এন আর সি হবে না৷ হলে তার মৃতদেহের উপর দিয়ে হবে৷ আরও দশটি রাজ্যের একই শ্লোগান 'নো এনআরসি'৷ যেখানে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভয় দিচ্ছেন 'ভয় পাওয়ার কারণ নেই' বলে৷ ঘোষণা করে দিয়েছে যে নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে আধার, ভোটার কোনো কাজে লাগবে না সেখানে সাধারণ মানুষ না বুঝলেও, ব্যাঙ্ক কর্মীরা তো বোঝেন৷ এত চাপ নাও নিতে পারতেন৷ আর, তেহট্টের মহাকুমাশাসক অনীশ দাশগুপ্ত ,জেলা সিনিয়র ডেপুটি কালেক্টর নীলাঞ্জন ভট্টাচার্যরা কি সেই অর্থে কিছুই বোঝেননা? উল্টে তারাই তো বিষয়টিতে জোড় দিয়েছেন৷ এক্ষেত্রে এলাকায় আলাদা কেন্দ্র করার কথা ভাবছেন৷  

আসলে নাগরিকত্ব সংশোধনী নিয়ে দেশের শাসকদল এপর্যন্ত যা যা ব্যাখ্যা করেছে তা শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেশিরভাগ নির্বিশেষে প্রত্যেকের কাছেই যেমন অস্বচ্ছ, তেমনই স্ববিরোধী৷  সম্প্রতি অসম এনআরসি থেকে নেওয়া অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গটিও হাল্কা করে দিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী ও তার অনুসারীরা৷ বলছেন 'ওদের' ব্যাক্তিগত বিষয়৷ প্রশ্ন হল অসম কি দেশের বাইরে? নাকি কাশ্মীর থেকে ৩৭০ধারা তুলে নেওয়ার পর থেকে জোর গলায় নিজেদেরই উক্তি 'এক দেশ এক আইন' কথার মানে নিজেরাই ভুলতে বসেছেন ?

আর অসমের নাগরিক তালিকা থেকে যারা বাদ পড়েছে তাদের দুর্দশা এখন আর কারোই অজানা নয়৷ যদিও এত প্রশ্ন শুনতে চাইছেনা শাসক শিবির৷ তারা শুধুই বোঝাতে চাইছে যে এনআরসি বিষয়ে তারা এবং তাদের সমর্থনকারীরা যেটা বলছেন সেটাই একমাত্র ঠিক৷ সুতরাং বিরোধীদের বিরোধিতাকে হাতিয়ার করে গেরুয়া শিবিরের মন গলানো এতসব ব্যাখ্যার পরেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন নিজেই বলছেন যে 'এনঅআরসি-র জন্য দেশের এক ইঞ্চিও ছাড়া হবেনা'৷ সুতরাং এর  থেকে মানুষ যে একটিমাত্র বিষয় বুঝতে পারছে তা হল যে কোন উপায় নাগরিকত্ব প্রমাণ করতেই হবে, আর এর কোনো দ্বিতীয় বিকল্প নেই৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *