শিক্ষা দপ্তরের ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ কেন বেসরকারি চ্যানেলে? ক্ষুব্ধ শিক্ষক মহল!

শিক্ষা দপ্তরের ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ কেন বেসরকারি চ্যানেলে? ক্ষুব্ধ শিক্ষক মহল!

 

কলকাতা: কলকাতা দূরদর্শনে ছাত্রছাত্রীদের জন্য প্রসাবিত 'ভার্চুয়াল ক্লাস' ক্লাস বাতিল করেছে রাজ্যের শিক্ষা দফতর। তবে, ইতিমধ্যেই একটি জনপ্রিয় বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে এই দায়িত্ব পেয়ে গিয়েছে। কেন সরকারি চ্যানেল হিসাবে পরিচিত দূরদর্শনকে পাওয়া গেল না, কেনই বা বেসরকারি ওই চ্যানেলকে বেছে নেওয়া হল? তা নিয়ে এবার প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন শিক্ষক মহলের একাংশ৷

করোনার আবহে রাজ্যের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ৷ স্তব্ধ বিভিন্ন পরীক্ষা৷ তিনটি বিষয় উচ্চ মাধ্যমিকের তিন দেনর পরীক্ষা এখনও বাকি থেকে গিয়েছে৷ এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি বড় ধাক্কার মুখে৷ এমন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাসরুম চালু রাখতে চাইছে৷ শিক্ষা দফতর সূত্রে খবর, সমস্ত স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলা হয়েছে, টিভিতে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমের ব্যাপারে ছাত্র ছাত্রীদের জানাতে৷ ছাত্র ছাত্রীরা যা অনুশীলন করবেন, পরে তা স্কুল খুললে শিক্ষক শিক্ষকাদের দেখিয়ে নিতে হবে৷ বেসরকারি ওই চ্যানেলে রাজ্য সরকারের ভার্চুয়াল ক্লাস নিয়ে ইতিমধ্যেই বিজ্ঞাপন দেওয়ার কাজ শুরু করেছে দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর৷ বাংলার শিক্ষা পোর্টালেও ভিডিও-সহ ভার্চুয়াল ক্লাসের সূচিও প্রকাশ করা হয়েছে৷ (বিস্তারিত দেখুন- https://banglarshiksha.gov.in/Frontend/online_classroom) কিন্তু, দূরদর্শনকে এড়িয়ে কেন বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে দায়িত্ব দেওয়া হল?  প্রশ্ন তুলছেন শিক্ষকদের একাংশ৷

বেসিরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে কেন এই ক্লাস নেওয়া হচ্ছে? কেন দূরদর্শনকে ব্যবহার করা গেল না? কী শর্তে বেসরকারি চ্যানেল এই ক্লাস নিতে রাজি হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষকদের একাংশ৷ এই প্রসঙ্গে শিক্ষক ঐক্য মুক্তমঞ্চের সাধারণ সম্পাদক মইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘‘দূরদর্শনকে এড়িয়ে বেসরকারি নিউজ চ্যানেলের মাধ্যমে সরাসরি ক্লাস নেওয়ার ঘোষণা রাজ্যের৷ শিক্ষাকে বেসরকারিকরণে দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এর থেকে নিন্দাজনক কিছু হয় না৷ এমনিতে শিক্ষাব্যবস্থা ধংসের দিকে আর এই সিদ্ধান্তকে তুঘলকি সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু বলার নেই৷ সাথে নির্দিষ্ট সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে শাসকদলের যে যোগসাজেশ তা গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে মারাত্মক এবং লজ্জাজনক৷ শিক্ষক ঐক্য মুক্ত মঞ্চ এর তীব্র বিরোধিতা করছি৷’’

শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘‘অভ্যন্তরীণ কোনও কারণ আছে কিনা জানি না৷ তবে এই দুঃসময়ে বেসরকারি চ্যানেলের পরিবর্তে সরকারি চ্যানেলে এই ব্যবস্থা চালু করতে পারলে জনগণের অর্থাৎ সরকারের অর্থ সাশ্রয় হত৷ বর্তমানে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অনলাইনের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষাদান পদ্ধতির সরকারি সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছি৷’’

মুর্শিদাবাদের শিক্ষক নেতা তন্ময় ঘোষ বলেন, ‘‘শিক্ষা দফতরের এমন তুঘলকি সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না৷ এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সরকারের ভাবা উচিত ছিল, সরকার পোষিত বিদ্যালয়গুলিতে পাঠরত শিক্ষকদের অধিকাংশই আসে সাধারণ পরিবার থেকে, অধিকাংশ শিক্ষার্থীদের বাড়িতে কেবল লাইন নাই, ফলে বেসরকারি চ্যানেলে পাঠদানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সমস্যা হবে,এছাড়া সরকারি চ্যানেল দূরদর্শনেকে এড়িয়ে বেসরকারি চ্যানেলকে বরাত দিয়ে সরকার কোনও সুবিধা পাইয়ে দিতে চাইছে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে৷’’

বিজেপি টিচার্স সেল (পশ্চিমবঙ্গ) তরফে দীপল বিশ্বাস বলেছেন,  ‘‘বর্তমান তৃণমূল সরকার জনগণের করের টাকায় সরকারি কোষাগার থেকে প্রচুর পরিমাণ অর্থ বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে প্রদান করে সরকারের প্রশংসাসূচক বিজ্ঞাপন দিচ্ছে৷ যাতে কোনও নিউজ চ্যানেল সরকারের খারাপ কাজগুলি প্রচার না করে৷ বিভিন্ন বাহানা দেখিয়ে বেসরকারি নিউজ চ্যানেলগুলিকে তুষ্ট করে রাখার জন্য সরকারি অর্থ তাদেরকে পাইয়ে দেওয়ার একটা ঘৃণ্য রাজনীতি৷ কেন্দ্র থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ জনগণের কল্যাণের জন্য রাজ্যকে প্রদান করা হচ্ছে তা বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনগণের উন্নয়নের কাজে ব্যবহার না করে মেলা, খেলা, ক্লাব, চলচ্চিত্রের‌ অভিনেতা-অভিনেত্রী, বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়, সংখ্যালঘু এদের প্রদান করে সকলের মুখ বন্ধ করে রাখার একটা ঘৃণ্য চক্রান্ত৷’’

সরকারি চ্যানেলকে এড়িয়ে বেসরকারি চ্যানেলে ‘ভার্চুয়াল ক্লাস’ চালুর পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হাণ্ডার প্রতিক্রিয়া, ‘‘সরকারের এহেন পদক্ষেপে সরকারি চ্যানেলের চেয়ে বেসরকারির প্রতি জনসাধারণকে বেশি উত্সাহিত করা হবে৷ যা অচিরেই সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার মতো মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে সাহায্য করবে৷ এছাড়া এতে কিয়দংশ ( মূলত শহরতলীর)  ছাত্র-ছাত্রীরা উপকৃত হবে, বাকি বেশিরভাগের জন্য কোনও উদ্যোগ আছে কি? শিক্ষামন্ত্রী মহাশয় সরকারি চ্যানেলে ক্লাস বন্ধ করবার দায় শিক্ষকদের ঘাড়ে চাপিয়ে ছেন৷ অথচ পূর্বের ন্যায় এবারও কি অনুষ্ঠান শুরুর সময় বাতিল হবে? কেবল হুকুম জারি করা, যা সম্পূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি বিরুদ্ধ৷’’

সরকারি এই ঘোষণা প্রসঙ্গে বাম যুব ছাত্র নেতা ইন্দ্রজিৎ ঘোষ জানিয়েছেন, ‘‘বেসরকারি নিউজ চ্যানেলকে এই দায়িত্ব না দিলেই ভালো হত৷ দূরদর্শের মাধ্যমে রাজ্য সরকারে ভার্চুয়াল ক্লাস কেন নেওয়া গেলে না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন৷’’ যদিও কলকাতা দূরদর্শন এই বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে শোনা যায়নি৷ সূত্রের খবর, রাজ্য সরকারের বিষয় বলে দূরদর্শন বিশেষ ভাবছে না৷

যদিও এর আগে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “আমরা বিভিন্ন মহল থেকে যে খবর পাচ্ছি, তার ভিত্তিতে মনে হচ্ছে ৪টে থেকে ৫টা পর্যন্ত আগামী ৭ এপ্রিল থেকে দূরদর্শনে ১ ঘণ্টার ক্লাস নেওয়ার কথা ছিল, তা লাভ জনক হচ্ছে না। অভিভাবকরা যে সময় চাইছেন, শিক্ষকরা যে সময় চাইছেন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দূরদর্শনে ৭ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত যে স্লট, তা স্থগিত রাখলাম। আমাদের নিজস্ব যে শিক্ষা পোর্টাল, অন্যান যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ছিল, তা বহাল থাকবে৷ অভিভাবক, ছাত্রসমাজ বড় কথা৷ এমন কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে তা উপকারে আসবে৷’’

যদিও ওই বেসরকারি চ্যানেলের তরফে আজ রাতে জানানো হয়েছে, রাজ্য সরকারকে তারা অনুষ্ঠানের সময় বিক্রি করেনি৷ সামাজিক দায় থেকেই এই সিদ্ধান্ত৷ কোনও বাণিজ্যিক চুক্তি ছাড়াই শিক্ষা দপ্তরের ভার্চুয়াল ক্লাস সম্প্রচারিত করা হবে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *