কিংকর অধিকারী: ঘটনা ১- আমার পরিচিত এক মাস্টারমশাই। সাদামাটা থাকতেন। বাড়িতে বাবা মা দুজনেই বয়স্ক। বাবা মারা গিয়েছেন কিছুদিন আগেই। স্ত্রী-সন্তান আর মাকে নিয়ে থাকতেন মাস্টারমশাই। বাবা মায়ের প্রতি তাঁর কর্তব্য পালন দেখে পাড়া পড়শিরা বলতেন, “একজন সন্তানের মত সন্তান পেয়েছিলেন বলে এই বৃদ্ধ বয়সে এত সেবা পাচ্ছেন এঁরা।” সত্যিই তাই। রোগশয্যায় দীর্ঘদিন কাটাতে হয়েছিল তাঁর মাকে। বিছানাতেই চান, খাওয়া-দাওয়া থেকে সবকিছুই করাতে হত। ছেলে এবং বৌমা, নাতি-নাতনিরা সবাই যে যার মতো করে বৃদ্ধা মহিলাটির প্রতি যত্ন নিতেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। মা তার প্রিয় সন্তান, বৌমা, নাতি-নাতনিকে ছেড়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মায়ের স্মৃতি বুকে চেপে রেখে চোখের জলে মা কে বিদায় দিতে হল। মা মারা যাওয়ার পর মাস্টারমশাই পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মায়ের দেহ মেডিকেল কলেজে গিয়ে দান করলেন। চক্ষুদানও করলেন। এবার মায়ের মৃত্যুর পরের কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সুসম্পন্ন করে নেওয়ার পালা।
কিন্তু অদ্ভুত বিষয়, সেই মাস্টারমশাই পারোলৌকিক ক্রিয়ার জন্য সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট করা নিয়ম কানুন কোনটাই পালন করলেন না। তা দেখে পাড়া পড়শীদের অনেকেই প্রশ্ন তুললেন, “এটা কখনো হতে পারে না। মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তি হবে না – এ কখনো মেনে নেওয়া যায়?” গ্রামের কিছু ব্যক্তি গিয়ে হাজির হলেন মাস্টারমশাই-এর বাড়ী। বাড়িতে মাস্টারমশাই তাঁদেরকে বসতে দিয়ে বললেন, “দেখুন, মা জীবিত থাকাকালীন যেটুকু করতে পেরেছি সেটাই আমার কাছে স্মৃতি হয়ে থাকুক। সমাজের দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা যেসব সামাজিক নিয়ম, তারমধ্যে মাকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানোর কিছুই নেই। জীবিত থাকা অবস্থায় আমি আমার সাধ্যমত যেটুকু করতে পেরেছি সেটাই আমার সম্বল। মা মারা যাওয়ার পর আর কিই বা করার আছে? আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি মায়ের একটি মূর্তি তৈরি করে বাড়ির সামনের উঠোনে প্রতিষ্ঠা করব এবং একটি দিন নির্দিষ্ট করে আপনাদের সবাইকে ডাকবো। আপনারাই মাকে যেমন ভাবে দেখেছেন আলোচনা করবেন। ওই দিনই আমি বিস্তীর্ণ এলাকার গরিব দুঃখীদের ডেকে তাঁদের আহারের ব্যবস্থা করব এবং তাঁদের জন্য একটি করে শাল প্রদানের মধ্য দিয়ে আমি আমার মাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই। কারণ তিনি তো শুধু তার নিজের সন্তানকে ভালবাসতেন না গ্রামের অন্যান্যদেরও নিজের সন্তানের মতো করে ভালোবাসতেন। মাকে সম্মান জানানোর জন্য এই পরিকল্পনাটি আমি করেছি। ফলে কোন ব্রাহ্মণ ডেকে অন্যান্য পারোলৌকিক ক্রিয়া কোন কিছুই আমি করতে চাই না। আমার মনে হয় আমার মা যেখানেই থাকুন না কেন, আমার এই কাজেই খুশি হবেন।” সবাই শুনে একে অপরের দিকে তাকালেন। কিন্তু যুক্তি দিয়ে কিছু বোঝানোর ভাষাই পেলেন না। কারণ সত্যিই তাঁরা দেখেছেন জীবদ্দশাতে মায়ের প্রতি তাঁর আচরণ এবং দায় দায়িত্ব বোধ। শেষ পর্যন্ত পাড়া-প্রতিবেশী মন থেকে না মানতে পারলেও বিরোধিতা করতে পারলেন না। কিছুদিন পরে পরিকল্পনা মতো সমস্ত কাজ গুছিয়ে করে ফেললেন মাস্টারমশাই। প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী মস্তক-মুণ্ডন পর্যন্ত করলেন না। বহু মানুষ বাড়িতে এসে আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন। ব্রাহ্মণ বা বৈষ্ণব ভোজন কোনোটাই হলোনা। এমন বিরল ঘটনা মনের স্মৃতিতে আজও উজ্জ্বল হয়ে আছে।
ঘটনা ২- আরেকটি ঘটনা যা সমাজে আপনারা আকচার দেখতে পান এরকমই একটি প্রত্যক্ষ করা ঘটনা এখানে তুলে ধরছি। একইভাবে অবস্থানবান এবং রোজগেরে এক ব্যক্তি স্ত্রী, পুত্র, সন্তান নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন যাপন করেন। বাবা নেই। মা বয়সের ভারে ক্লান্ত। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে মানুষ করেছিলেন মা। ছেলে রোজগেরে হওয়ার পর মা খুশিতে ডগমগ। ঘটা করে ছেলের বিয়ে দেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের সঙ্গে স্ত্রীর বনিবনা না হওয়ায় মাকে আলাদা করে দিয়ে নিজের পরিবার নিয়ে সরে পড়েন তিনি। বৃদ্ধা মা অতিকষ্টে কালাতিপাত করেন। পাড়ার লোকজন দেখে ছিঃ ছিঃ করতে থাকেন। মায়ের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, রোগভোগ সবকিছুতেই ছেলে নির্বিকার। নিজের সন্তানের পড়াশোনা, স্ত্রীর আবদার, সংসারের হাজার ঝামেলা ইত্যাদিতেই তাঁর সময় শেষ। বাড়তি সময় কোথায় মায়ের জন্য? মায়ের নামে নানান অজুহাত খাড়া করে ছেলে নিজের মতো আলাদা ভাবে চলতে থাকে। মা লোকজনের কাছে হা হুতাশ করে বলে, “এত কষ্ট করে পুত্র সন্তানকে মানুষ করে শেষ পর্যন্ত এই প্রতিদান পেলাম!” বয়সের ভারে শেষ পর্যন্ত কষ্ট-যন্ত্রণা বুকে চেপে মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
এরপরই টনক নড়ে ছেলের। পাড়া-প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের পারোলৌকিক ক্রিয়ার যাবতীয় কাজকর্ম সেরে ফেলার তোড়জোড় শুরু করে দেন তিনি। বিরাট আয়োজন। শ্মশানে দাহ, শ্রাদ্ধশান্তি, ব্রাহ্মণ ডেকে সামাজিক যা কিছু নিয়ম একটুও যেন তাঁর ত্রুটি না হয় তার অদম্য প্রয়াস। অনেক লোক ডেকে খাওয়া দাওয়া এলাহি ব্যাপার। মানুষ দেখল ছেলের মাতৃভক্তি। বাহবা দিয়ে গেলেন অনেকেই। ব্রাহ্মন ভোজন, বৈষ্ণব ভোজন, মস্তক মুন্ডন কোন কিছুই বাদ গেল না। সবকিছুই হলো অনেক পরিপাটি করে। যেন কোনো খামতি নেই।
দুটি ঘটনা জানার পর আপনারাই বলুন মাতৃভক্তিতে কোন মানুষটি এগিয়ে? সমাজ কাকে মূল্য দেবে? আমরা কাকে মূল্য দেবো? নিজেদের মায়ের জায়গায় যদি দেশটাকে বসিয়ে একই ভাবে আমরা ভাবতে পারি তাহলে কোন দেশপ্রেম আমদের জন্য মঙ্গল?