গরীব-চোর-মাতাল ভূমিকায় বাঙালিকে মাতিয়ে শেষ জীবনে কী পেলেন অভিনেতা সুনীল?

বাংলা ছবিতে মূলত চাকর বা ওই প্রকার প্রান্তিক চরিত্রেই অভিনয় করতেই দেখা গেছে সুনীল বাবুকে। খুবই ছোট ছোট ভুমিকায় কাজ করতেন। কিন্তু তাতেই হাসি কান্না মিলিয়ে অভিনয়ের ক্ষমতায় দর্শকের মন জয় করে নিতেন তিনি। আসলে এটাই হল একজন অভিনেতার পরিচয়। কাজ কখনওই ছোট হয় না, অতি ক্ষুদ্র চরিত্রেও নিজের অভিনয় ক্ষমতার ১০০ শতাংশ দেওয়াই একজন সেরা অভিনেতার মূল বৈশিষ্ট্য।

 

কলকাতা: এ বছর ভারতীয় দর্শক অনেক বিখ্যাত অভিনেতাদের হারিয়েছেন। কিন্তু টালিগঞ্জে এক সময় মেগা সিরিয়াল থেকে বাংলা সিনেমায় অতি পরিচিত মুখের এমন একজন ছিলেন, যাঁকে টলি পাড়ার পাশাপাশি দর্শক আজ মনেও রাখেনি। নীরবেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন তিনি। এমনকি তাঁর মৃত্যুর তারিখ সম্পর্কেও স্পষ্ট জানা যায় না। তাঁর নাম সুনীল মুখোপাধ্যায়। এই অভিনেতা টলি পাড়ায় পরিচিত হলেও, ইন্ডাস্ট্রির তালিকায় শেষমেশ ব্রাত্যই থেকে গেছেন।

বাংলা ছবিতে মূলত চাকর বা ওই প্রকার প্রান্তিক চরিত্রেই অভিনয় করতেই দেখা গেছে সুনীল বাবুকে। খুবই ছোট ছোট ভুমিকায় কাজ করতেন। কিন্তু তাতেই হাসি কান্না মিলিয়ে অভিনয়ের ক্ষমতায় দর্শকের মন জয় করে নিতেন তিনি। আসলে এটাই হল একজন অভিনেতার পরিচয়। কাজ কখনওই ছোট হয় না, অতি ক্ষুদ্র চরিত্রেও নিজের অভিনয় ক্ষমতার ১০০ শতাংশ দেওয়াই একজন সেরা অভিনেতার মূল বৈশিষ্ট্য। সারা জীবন ধরেই সমাজের প্রান্তিক শ্রেণির মুখ হিসাবেই থেকে গিয়েছেন সুনীল।

সুনীলের অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল মঞ্চে অভিনয়ের মাধ্যমে। বিখ্যাত অভিনেতা, পরিচালক উৎপল দত্তে'র নাট্যদলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সুনীল। পরে বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত পরিচালক মৃণাল সেনে'র হাত ধরে ছবিতে পা রাখেন সুনীল। সিনেমা হিসাবে 'কলকাতা ৭১' ছবিতেই তাঁর প্রথম কাজ। না না এই ছবিতে এখন তাঁকে দেখতে পাবেন না, কেননা তাঁর অভিনয়ের জায়গাটি সম্পাদনার সময় বাদ পড়েছিল।

এরপর আরেক বিখ্যাত পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের 'নিম অন্নপূর্ণা' ছবিতে সুনীলকে প্রথম রূপালি পর্দায় দেখা যায়। এই ছবিতে সুনীল মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই সময় এই ছবি নিয়ে সমালোচক মহলেও বহু আলোচনা হয়েছিল। দর্শকের কাছে এই ছবিটি সাড়া ফেলেছিল। এর পরেও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যান সুনীল।

'নিম অন্নপূর্ণা' ছবির পোস্টার

এরপর দিলীপ রায়ের বহু চর্চিত 'অমৃত কুম্ভের সন্ধানে' ছবিতে কাজ করেন সুনীল। পাশাপাশি, মৃণাল সেনের সঙ্গে দ্বিতীয় বারের জন্য 'খারিজ' ছবিতে কাজ করার সুযোগ হয় তাঁর। এরপর গৌতম ঘোষের 'পার', 'আবার অরণ্যে', 'কালবেলা' ছবিতে কাজ করেন সুনীল। অপর্ণা সেনের বিখ্যাত ছবি 'মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার' এও কাজ করতে দেখা যায় সুনীলকে।

গৌতম ঘোষের 'পদ্মানদীর মাঝি' ছবিতে অভিনয়ের ফলে বাংলাদেশেও সুনীল মুখোপাধ্যায় অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। এর পাশাপাশি কলকাতার মেইনস্ট্রিম ঘরানার পপুলার ছবিতেও সমানভাবে কাজ করে যান সুনীল মুখোপাধ্যায়। থেমে থাকেনি টেলিভিশনের কাজও। সুনীল তাঁর কাজের জন্য সম্মানও কুরিয়েছিলেন প্রচুর। বিএফজেএ'র বিচারে তিন বার সেরা সহ অভিনেতা মনোনীত হয়েছিলেন তিনি। ছবি ও টেলিভিশনের পাশাপাশি মঞ্চেও নিয়মিত অভিনয় করতেন সুনীল। 'ক্যালকাটা পিপলস আর্ট থিয়েটারে'র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সুনীল মুখোপাধ্যায়।

'হীরের আংটি' ছবিতে চোর ষষ্ঠীকে হয়ত দর্শক এখনও ভুলতে পারেনি। ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম ছবি হিসাবে এই ছবি টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয়েছিল। এই ছবিতে ওই চোরের ভুমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুনীল। পনেরো বছর আগের টিভি সিরিজ আজকের থেকে অনেক আলাদা ছিল। শাশুড়ি বউমার ঝগড়াঝাটির বাইরে বাস্তবধর্মী বা সাহিত্যধর্মী বিষয় নিয়ে পরীক্ষামূলক কাজ করা হত সেই সময়। তখন একাধিক টেলিছবিতেও সুনীলকে অভিনয় করতে দেখা গিয়েছিল। পাশাপাশি বেশ কয়েকটি ছবিতে সুনীলকে কমেডিয়ানের চরিত্রেও দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ, যীশু সেনগুপ্ত অভিনীত প্রথম ছবি দীনেন গুপ্তে'র 'ঋণমুক্তি'তে সুনীলকে কমেডিয়ানের চরিত্রে দেখা যায়। তাঁর চরিত্রটির বৈশিষ্ট্য ছিল সে সত্যবাদী এবং নিরপেক্ষ। ওঁর সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকা ব্যাক্তিদের কথায়, সুনীল বাস্তব জীবনেও রসিকতা করতে পছন্দ করতেন, খুব খোলা মনের মানুষ ছিলেন সুনীল।

এত বিখ্যাত পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করার পরেও অভিনয় পেশা থেকে আর্থিক সচ্ছলতা পাননি সুনীল। আগে ঢাকুরিয়ায় থাকতেন, বিয়ের পর সুনীল সস্ত্রীক গড়িয়া নবপল্লি অঞ্চলে চলে আসেন। আজীবন ভাড়া বাড়িতেই বসবাস করতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। চেনা মুখ হলেও বাসে করেই যাতায়াত করতেন তিনি, গাড়ি কেনার বিলাসিতা তাঁর দ্বারা হয়নি। কখনওই অহংকারবোধ জাগতে দেননি নিজের মধ্যে।

শেষজীবনে শরীরের ধকল সহ্য করতে পারেননি তিনি। 'সকাল সন্ধ্যা' ছবির শুটিংয়ের সময় একটি দৃশ্যে সুনীলকে একটি বাচ্চা মেয়েকে কোলে তুলে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হবে সুনীলকে। রোগা মানুষটির শরীরে জোর ছিল না তেমন। একপ্রকার জোর করেই ওই দৃশ্যে অভিনয় করতে শুরু করলেন সুনীল। কিন্তু এক সময় ভার বহন করতে না পেরে ওই মেয়েটিকে সিঁড়িতে ফেলে দেন সুনীল। চোট খেয়ে বেজায় ক্ষেপে ওঠে ওই মেয়েটি। এরপর প্রোডাকশনের সকলে সুনীলকে দোষারোপ করতে শুরু করেন। অবশেষে সহ অভিনেত্রী সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছিলেন।

অভিনেতা সুনীল মুখোপাধ্যায়

শেষজীবনে একঘেয়ে চরিত্র পাওয়ার জন্যে কাজ করা কমিয়ে দিয়েছিলেন সুনীল। তিনি বলতেন, “দুস্থ, গরীব, চোর, মাতাল এই রকমের রোল আমি বাঙালি জাতিকে অনেক দিয়েছি, আমার পাওয়ার আর কিছু নেই।” শেষে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগেছিলেন এই অভিনেতা। টিবি রোগের শিকার হয়েছিলেন সুনীল। যাদবপুরের কেপিসি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বিশাল অঙ্কের চিকিৎসা খরচ সামলাতে না পেরে সুনীলের দুই পুত্র 'আর্টিস্ট ফোরাম' ও 'সিনে টেল' সংস্থার কাছে আবেদন করেছিলেন। দুই সংস্থা সুনীলের পাশে দাঁড়য়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। ২০১২ সালের মে মাসে সুনীল মারা যান। সুনীলের শেষকৃত্যে কেউ আসেননি তাঁকে সম্মান জানাতে। নীরবেই এই পৃথিবীর তথা অভিনয় জীবনের মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন সুনীল মুখোপাধ্যায়।

সুনীলের এই কাহিনী নতুন নয়। এর আগেও ছোট ছোট চরিত্র থেকে উঠে আসা অভিনেতারা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেছেন। প্রশ্ন হল এই সব প্রতিভাবান অভিনেতাদের শেষজীবনের এই করুন দশার জন্য কি চলচ্চিত্র জগত, সরকার কিংবা দর্শককুল কোনও ভাবেই দায়ি নয়? ছবির স্বার্থে যখন এই ছোট ছোট চরিত্র খুব গুরুত্ব পায়, তখন বাস্তবে এই সমস্ত চরিত্রগুলিকে সম্মান দেওয়া রক্তমাংসের মানুষগুলোকে প্রাপ্য সামান্য মর্যাদাটুকুও কি দেওয়া যায় না? প্রশ্ন থেকে যাবেই। সুনীলের মতো হয়ত আরও কয়েকজনের ক্ষেত্রেও একই ধারা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু বেঁচে থাকবে এঁদের লড়াই। ঋত্তিক বাবুর কথায়, দুনিয়ায় টাকা থাকবে না, কিন্তু কাজগুলো থেকে যাবে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *