মা, শিশুকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে গিয়ে সরকারি অবহেলায় আশা কর্মীদের জীবন আজ বিপন্ন!

মা, শিশুকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে গিয়ে সরকারি অবহেলায় আশা কর্মীদের জীবন আজ বিপন্ন!

কিংকর অধিকারী:  সারা দেশ জুড়ে গ্রামীণ স্তরে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিরাট অংশ টিকিয়ে রেখেছেন আশাকর্মীরা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্য সরকার তাঁদের উপর ভর করেই গর্বের সঙ্গে কৃতিত্ব জাহির করছেন মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমে যাওয়ার জন্য। পোলিও মুক্ত ভারত ঘোষণা করার পিছনে সিংহভাগ অবদান এই আশা কর্মীদের। অথচ যে আশা কর্মীরা অন্তরালে থেকে নিরলসভাবে দেশের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি পালন করে চলেছেন তাঁদের প্রকৃত অবস্থা শুনলে চমকে উঠবেন সবাই! তাঁরা যখন অন্যান্য পরিবারের মা, শিশুসহ সবাই যাতে সুস্থ থাকে তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তখন তাঁদের নিজের সন্তান এবং মা হিসাবে তাঁর নিজের স্বাস্থ্যের যে করুণ অবস্থা সেদিকে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই!

     পশ্চিমবঙ্গে গত ২০০৫ সাল থেকে মাসে মাত্র ৮০০ টাকা ভাতা দিয়ে মহিলাদের নিয়োগ করা শুরু হয়েছিল এই কাজে। স্বাভাবিকভাবে এত অল্প টাকায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের মহিলারা ভবিষ্যতে কোনো সুরাহা হবে সেই আশায় এই কাজে যোগ দিয়েছিলেন। আজও তাঁরা সেই আশায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। আজ প্রায় 15 বছর অতিক্রান্ত। কেন্দ্রীয় সরকারের NHM-National Health Mission কাজের ভিত্তিতে (ফরমেট) যে অর্থ দেয় তার পরিমাণ মাসে সাকুল্যে গড়ে প্রায় ১০০০-১৫০০ টাকা। আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার খেপে খেপে বাড়িয়ে বর্তমানে তাঁদের ভাতা দেয় মাসে মাত্র ৩৫০০ টাকা। এইভাবে মাসে ৪৫০০ থেকে ৫০০০ টাকার বিনিময়ে তাঁদের অমানুষিকভাবে খাটিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর পরেও কোনো কারণে আশা কর্মীগণ অসুস্থ হয়ে কোনো কাজে অনুপস্থিত হলে সেই কাজের ভিত্তিতে ফরমেট অনুযায়ী বরাদ্দ অর্থ কেটে নেওয়া হয়। সপ্তাহে নির্ধারিত প্রতি বুধবার আশা কর্মীদের কাজের দিন যদি সরকারিভাবে ছুটি থাকে তাহলে সাব সেন্টার বন্ধ থাকার কারণে ফরমেট অনুযায়ী ঐ দিনের বরাদ্দ অর্থও কেটে নেওয়া হয়।

     এবার এই সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাঁদের কি কি করতে হয় দেখুন। আপনি চমকে যেতে পারেন কিন্তু সরকার চমকায় না। নিয়মে বলা হয়েছে আশাকর্মীদের কাজ দিনে পুরো ২৪ ঘন্টাই। ৩৬৫ দিনে তাঁদের যে কোনো সময় কাজ দেওয়া যাবে। প্রতি সপ্তাহে একদিন সাব-সেন্টারে পূর্ণ সময়ের জন্য ডিউটি, অন্যান্য দিন এলাকায় এলাকায় মা ও শিশুদের বিভিন্ন বিষয়ে খবরা খবর, ঔষধপত্র বিতরণ, গর্ভবতী মহিলাদের প্রসবের জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া সহ নিত্যনতুন কাজের নির্দেশ পালন করতে হয়। সাব সেন্টারে ডিউটি ছাড়াও একাধিক ভিএইচএনডি ক্যাম্পে(অন্যান্য গ্রামীণ এলাকায়) পূর্ণ সময়ের জন্য ডিউটি পালন করতে হয়। এছাড়া নিজের অঞ্চলে, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়মিত মিটিং-এ উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ গ্রহণ ও সেখানে সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্যের যোগান দিতে হয়। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নার্সদের মতো এক মাস দিবারাত্রি ডিউটি দিতে হয় আশা কর্মীদের মাত্র 2000 টাকার বিনিময়ে, যা দিশা ডিউটি নামে পরিচিত। উল্লেখ্য ওই সময়ে তাঁদের ফরমেটের টাকা দেওয়া হয় না। এরপরও প্রায় প্রতি বছরই ঘর সংসার ছেড়ে ৮ দিন অথবা ১৫ দিনের জন্য বাইরে ট্রেনিংয়ে যেতে হয় বাধ্যতামূলকভাবে। 

     বাস্তব ক্ষেত্রে এইসব কাজ ছাড়াও যখন তখন অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। প্রথমে শুরু হয়েছিল মা ও শিশুর স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সমস্যা নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে ৩০ বছরের উর্ধ্বে নারী পুরুষের অসংক্রামক রোগ যেমন ব্লাড সুগার, নানা ধরনের ক্যান্সার, হাইপ্রেসার ইত্যাদি, আর সকলের ক্ষেত্রে সংক্রামক বা অসংক্রামক রোগ যেমন টিবি, কুষ্ঠ, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, ডাইরিয়া, স্ক্রাব টাইফাস সন্দেহ ব্যক্তিদের চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানো এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে আয়রন ট্যাবলেট বিতরণ এবং মাসে মাসে তার রিপোর্ট সংগ্রহ ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য আলোচনা সভার আয়োজন করতে হয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা কেন্দ্রে ডিউটি, মেলা বা খেলায় ডিউটি, কার বাড়িতে পানীয় জলের ব্যবস্থা কেমন, শৌচালয় আছে কিনা এবং তা ব্যবহার করা হয় কিনা, পানাপুকুর আছে কিনা, কিশোর-কিশোরীদের সচেতনতা বৃদ্ধি, চোখের ছানি, মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য পরামর্শ ও সচেতনতা বৃদ্ধি, ভি এইচ এন সি কমিটির আহ্বায়ক হিসাবে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কাজ করতে হয় আশা কর্মীদের। এতসব কাজের পর সময় বের করে ১২/১৪ রকমের রেজিস্টার খাতায় সারা মাসের কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ উল্লেখ করতে হয়। উল্লেখ্য এসবের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ফরমেটে কোনো পারিশ্রমিক বরাদ্দ নেই। এরপরও কোনো আশাকর্মী তার নিজের বা পরিবারের কারো চিকিৎসার জন্য বা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যেতে চাইলে তাঁকে বিএমওএইচ-এর কাছে  লিখিতভাবে আবেদন করতে হয়। যদি অনুমোদন মেলে তবেই তিনি যেতে পারেন। এছাড়াও বহু ক্ষেত্রে সামান্য ভুল ত্রুটির জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সহানুভূতির পরিবর্তে মানসিক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়।

     একজন মহিলা হিসাবে পরিবারের সমস্ত দায় দায়িত্ব সামলানোর সাথে সাথে সারাদিন এইসব কাজ বা নির্দেশ পালন করতে গিয়ে নিজের সন্তান, পরিবার ও নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেওয়ার কোনো সময় থাকে কি? ফলে অধিকাংশ আশাকর্মীদের শরীরে বাসা বাঁধছে বিভিন্ন ধরনের রোগ। একজন মা হয়ে অন্য মা ও শিশু এবং এলাকার অন্যান্য প্রতিটি পরিবারের স্বাস্থ্য বিষয়ক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের জীবন, পরিবার ও তাঁর সন্তানের স্বাস্থ্য ও দায় দায়িত্ব কি পালন করতে পারেন? সরকারি বা বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে মহিলারা ১৮০ দিনের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি পান অথচ আশা কর্মীদের জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৪৫ দিন! সামান্য ৪৫০০/৫০০০ টাকার বিনিময়ে গাধার খাটুনি খাটিয়ে এভাবেই তাঁদের দিয়ে সরকার নিজের কৃতিত্ব জাহির করছে। সারা দেশ তথা রাজ্যের হাজার হাজার এই সব মায়েদের জীবন কিভাবে কাটছে কেউ কি উপলব্ধি করেছেন? সরকার কিন্তু নির্বিকার। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বহুবার দাবি জানিয়ে কোন প্রতিকার হয়নি। সারাদেশের প্রতিটি রাজ্যেই এই করুণ চিত্র লক্ষ্য করা যাবে। এ রাজ্যের রাজ্য সরকার সামান্য কিছু অর্থ বৃদ্ধি করার মাধ্যমে ক্রমাগত হাজার কাজের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। বর্তমান দুর্মূল্যের বাজারে এই সামান্য অর্থ দিয়ে কি একটা পরিবারের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো সম্ভব? তাঁদের জন্য নেই কোন নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো, নেই বোনাসের ব্যবস্থা, নেই নির্দিষ্ট কোনো ছুটি,  নেই কোন গ্রাচুইটি বা পেনশনের ব্যবস্থা। এইসব মায়েদের এবং তাঁদের পরিবারের দুরবস্থার হাত থেকে রক্ষা করবার জন্য সমাজের সর্বস্তর থেকে দাবী উঠুক।

মতামত লেখকের নিজস্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *