ভিন্ রাজ্যে কাজে গিয়ে বিরল রোগে আক্রান্ত বাংলার বহু শ্রমিক

ভিন্ রাজ্যে কাজে গিয়ে বিরল রোগে আক্রান্ত বাংলার বহু শ্রমিক

0c6a050e0431faea3b5f1c82efc78f4b

ঝাড়গ্রাম: ভিন রাজ্যে কাজে গিয়ে সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়ে ঝাড়গ্রামের বহু মানুষ মৃত্যুর দিন গুনছেনl  মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলের টি.বি ওয়ার্ডের ৮নম্বর বেডে গত ২৬দিন ধরে ভর্তি রয়েছেন  ৪৭বছরের গোবিন্দ জানা৷ আড়াই মাস ধরে ওড়িশার কটক, কলকাতার পিজি, বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ, ঝাড়গ্রাম সুপার স্পেশালিটি ও নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হয়ে ভাঙাগড় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসা করানোর পর তিনি শেষমেষ  ঠাঁই নিয়েছেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ।  সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে সিলিকোসিসের বিষ। ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল থানার কদমডিহা গ্রামের বাসিন্দা মৃত্যু পথযাত্রী গোবিন্দের স্ত্রী মলিনা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জানালেন, সব বেচে দিয়েছি স্বামীকে বাঁচাতে গত একবছর ধরে ঘুরছি হাসপাতালে হাসপাতালে। কিন্তু আশা নেই। দুটো পা ফুলে গেছে। নিঃস্ব হয়ে গেছি ১৭বছরের ছেলেকে নিয়ে এবার কোথায় দাঁড়াব জানি না৷

ঝাড়গ্রামের নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের সংক্রমণ বিভাগের ৪ নম্বর বিছানায় ভর্তি রয়েছেন ২৫ বছরের তাপস  দণ্ডপাট৷ ছেলের করুণ অবস্থা দেখে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে জানালায় মাথা ঠুকে চলেছেন গোপাল দণ্ডপাট৷ একমাত্র ছেলের  নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো। এক বছর আগে  তাপস কাজ করতে গিয়েছিল  পাশের ঝাড়খণ্ড রাজ্যের বিষ্টুপুরের পাথর গুঁড়ো করার ক্রেসার কারখানায়। গুগুল সার্চ করে সে জানতে পারে এই ক্র্যাশার থেকেই ছড়ায় মারন রোগ সিলিকোসিস। কিন্তু পালিয়ে এসেও রক্ষা নেই। প্রথমে কাশি তারপর   শ্বা:সকষ্ট আর জ্বর শুরু হয়। চিকিৎসার জন্য প্রথমে কটক তারপর কলকাতার পিজি এবং  দিল্লির এইমসে ভর্তি করানো হয়। ফুসফুসে বাইপাশ সার্জারি করার পর সেখান দিয়েই সরবরাহ করা হত অক্সিজেন। এরপর বাড়ি এসে ফের অসুস্থ হয়ে পড়ে সে৷  নয় দিন আগে তাকে নয়াগ্রাম সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নয়াগ্রাম থানার ডাহি গ্রামের বাসিন্দা গোপাল দণ্ডপাট  জানিয়েছেন, একমাত্র ছেলে তাপসকে বাঁচাতে ঘটি বাটি সব বিক্রি হয়ে গিয়েছে।

একই ভাবে  এক বছর আট মাসের ছেলেকে নিয়ে অবিরাম কেঁদে চলেছেন ২০বছরের নমিতা পাত্র। নয়াগ্রাম থানার রাইপড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা নমিতার স্বামী  ২৪বছরের মিলন গত দেড়বছর ধরে সিলিকোসিসে আক্রান্ত।   কলকাতার পিজি হাসপাতলে এক বছর ধরে চিকিৎসা হয়েছে তার। অকাল বৈধব্যর আশঙ্কায় তিনবছর আগে বিয়ে হওয়া তরুনীর আজ দিশেহারা অবস্থা।

একবছর আগে কাজে গিয়ে ছয় মাসের মধ্যে  মারা গেছে নয়াগ্রামের  বাহিনী গ্রামের দেবেন্দ্র বেরার  ১৯ বছরের ছেলে সুব্রত বেরা৷ খড়গপুর হাসপাতাল থেকে  মেদিনীপুর  মেডিক্যাল কলেজে  স্থানান্তর করার সময় তার মৃত্যু হয়৷ সিলিকোসিসে মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে রামকৃষ্ণ মন্ডল ওরফে সনু ৷  বয়স ২১ বছর৷ তার বাড়ি বর্ধমানে  হলেও বিবাহসূত্রে শ্বশুর বাড়ি  নয়াগ্রামের ডাহিতে থাকতেন। খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়৷ ৮ মাসের একটি পুত্র সন্তান আছে তাদের। মৃত্যুর তালিকায় রয়েছে আরো নাম৷ নমিতা বেরা জানিয়েছেন তাঁর স্বামীর সঙ্গে কাজ করা  কালাচাঁদ বেরা নামের এক তরুণ  ক'দিন আগেই মারা গিয়েছেন।

জঙ্গল মহলের একঝাঁক তাজা প্রান একটা একটা করে এভাবেই নিভে যাচ্ছে মারাত্মক সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে। দিন মজুর, মৎস্যজীবী পরিবারের অসহায় বেকার ছেলেরা কাজের সন্ধানে বেরিয়ে দালাল মারফত পাশের  রাজ্যের জামসেদপুরে ক্রাসারে কাজ নেয়৷ জানা গিয়েছে, কেশিয়াড়ীর নছিপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পনশগঞ্জ গ্রামের বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত নয়াগ্রাম সাঁকরাইল কেশিয়াড়ী ও দাঁতন থানা এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে জামশেদপুরের কারখানায় শ্রমিক সরবরাহ করেন। যাঁদের অনেকেই  রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালে ও দিল্লির এমস হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন বলে জানা গিয়েছেন
 সাঁকরাইল থানার  কদমডিহা গ্রামের গোবিন্দ জানা, নয়াগ্রামের নিমাইনগর রাইপড়িয়া গ্রামের মিলন পাত্র কিংবা  তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষা না দেওয়া তাপস দণ্ডপাটরা ছাড়াও পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ীর কাঞ্চনপুর ও দাঁতনের এক জন করে মোট তিনজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। কেশিয়াড়ীর পনশগঞ্জ বাসিন্দা বুদ্ধদেব দাস পিজি হাসপাতাল হয়ে দিল্লির এইমসে চিকিৎসায় রয়েছে। সিলিকোসিস  আক্রান্তদের প্রতিটি পরিবার আজ দিশাহারা। দেনার দায়ে বিকিয়ে যাচ্ছে ঘটি বাটি।

অথচ নিয়ম অনুযায়ী সিলিকোসিস রোগীদের পুরোপুরি সহায়তা করার কথা সরকারের। মৃতদের ক্ষতিপূরন পাওয়ার কথা। কিন্তু তারা কিছুই পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন আক্রান্তদের পরিবারের লোকজন। নমিতা বেরা বলেন ,  রিপোর্ট তো হাসপাতাল থেকেই সরকারের ঘরে যাওয়ার কথা ৷তারপর সরকারি আধিকারিকদের আক্রান্ত পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ানোর কথা।  পরিবার গুলির অসহায় অবস্থা দেখে  চিকিৎসকরাই সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিচ্ছেন। মামলা করলে চিকিৎসা বাবদ সমস্ত খরচ দিতে বাধ্য সরকার। কিন্তু কে যাবে ওই ঝামেলা পোহাতে? এমনিতেই রোগী নিয়ে নাজেহাল পরিবারগুলি। ঝাড়্গ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে নিয়ম অনুযায়ী আক্রান্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা আবেদন জানালে সরকারি সহায়তা দেওয়া হয়৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *