পঙ্গু বাবা, দাদা অসুস্থ! দারিদ্রতা ভুলে পথের ৩০০ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ত্রাতা বাংলার দেবকুমার

পঙ্গু বাবা, দাদা অসুস্থ! দারিদ্রতা ভুলে পথের ৩০০ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ত্রাতা বাংলার দেবকুমার

কলকাতা: কংক্রিটের দুনিয়ায় ক্রমশই ফিকে হচ্ছে মানবিকতা ৷ হিংসা-হানাহানি গিলে খাচ্ছে মানব সভ্যতাকে ৷ সন্তানের উদাসীনতায় বাবা মায়ের স্থান হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমের কোনও এক অন্ধকার ঘরে ৷ এই উদাসীনতায় ভর করেই শহরের বুকে ছত্রাকের মতো বেড়ে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম ৷ শেষ বয়সের এই ঠিকানা যে সবসময় সুখকর হয় তা কিন্তু নয় ৷ প্যাকেজের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয় বৃদ্ধ বাবা-মাকে ৷ সস্তার ঠিকানায় মাথা গোঁজা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের পেটভরা খাবরটুকুও জোটে না ৷ ঠাঁই হয় আলো-আধারির ছোট্ট ঘরে ৷ তবে টাকা ফেললে খানিকটা নিশ্চিন্ত ৷ কিন্তু সকলের গ্যাঁটে টাকা কই? বৃদ্ধাশ্রম তো দূরস্ত ৷ মাথার উপর ছাদটুকুও থাকে না ৷ এমনই প্রায় ৩০০ মানুষের ত্রাতা দেবকুমার মল্লিক৷

ঝড়ের দাপট হোক বা কাটফাটা রোদ্দুর কিংবা অঝোর বৃষ্টি এই অসহায় মানুষগুলি জানে ‘ছেলে’ তাদের ভুখা রাখবে না ৷ প্রকৃতিকে হার মানিয়ে পৌঁছে দেবে মধ্যাহ্নভোজ এবং নৈশভোজ ৷ এর কোনও ব্যতিক্রম নেই ৷ শারীরিক অসুস্থতা হোক বা সামান্য ঘুরতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ হলেই এক ফোনেই হাজির দেব কুমার ৷ বছর চল্লিশের দেবকুমারবাবু বলেন, ‘‘ আমি বহু প্রবীণ মানুষকে দিনের পর দিন রাস্তায় ধারে অনাহারে দিন কাটাতে দেখেছি ৷ আবার এমন মানুষও দেখেছি যারা বাড়িতে থেকেও খেতে পায়নি ৷ কারণ তাঁদের ছেড়ে চলে গিয়েছে তাঁদের সন্তানেরা৷’’ চরম দারিদ্রতা তো আছেই, সঙ্গে দোসর একাকীত্ব ৷ ভাঙাচোরা এই সব বাড়িতে জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া মানুষগুলির পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন দেবকুমারবাবু ৷

কলকাতার বরাহনগরে জন্ম ও বেড়ে ওঠা দেবকুমারের ৷ নিজের জীবনেও অনেক চড়াই উতরাই দেখেছেন তিনি ৷ বাবা-মা আর দুই ভাইকে নিয়ে ছিল তাঁদের ছোট্ট সংসার ৷ কিন্তু জীবন কখন সহজ পথে হাঁটে না ৷ একটি দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে যান তাঁর বাবা ৷ পরিবারের হাল ধরতে পড়ানো শুরু করেন তাঁর মা ৷ পাশাপাশি পার্টটাইম ফিজিওথেরাপির ক্লাস নিতেও শুরু করেন তিনি ৷ এমন সময় মস্তিষ্কের জটিল রোগে আক্রান্ত হন দেবকুমারবাবুর দাদা ৷ তাঁকে পাঠাতে হয় রিহ্যাবিলিয়েশনে ৷ সকাল বেলা রান্না সেরে বড় ছেলের সঙ্গে দেখা করতে চলে যেতেন তাঁর মা ৷ এর পর শুরু হত সারা দিনের যুদ্ধ ৷ বাড়িতে অসুস্থ বাবার সঙ্গে থাকতেন দেব কুমার ৷ ‘‘বাবাকে খাইয়ে ছুটতাম স্কুলে ৷ টিফিনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫০ পয়সা ৷ আমারও ইচ্ছা হতো তুতো ভাইদের মতো রঙিং টিফিন বক্সে ভরপেট খাবার নিয়ে স্কুলে যেতে ৷ এই ইচ্ছায় বাধ সাধতো আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ৷’’

উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় স্থানীয় ক্যাটারিংয়ে ওয়েটারের চাকরি শুরু করেন দেবকুমার মল্লিক ৷ বেতন ছিল স্বল্প ৷ পাওনা বলতে পড়ে থাকা স্ন্যক্স বা মিষ্টি বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন  মালিক ৷ অসুস্থ বাবার জন্য হাতে করে সেই খাবার নিয়ে আসতেন। মনে মনে ভাবতেন একদিন সফল হবেনই ৷ পুরনো স্মৃতি হাতড়ে দেবকুমারবাবু বললেন, পাড়ার ছেলেরা ভালোমতোই জানত আমার বাড়ির পরিস্থিতির কথা ৷ তারাও কোনও দিন খোঁচা দিতে ছাড়ত না ৷ ফুটবলে পা দিতে গেলে বলত, খেলতে গেলে টাকা লাগবে ৷

কলেজে পড়ার সময় এক ব্যক্তির সফলতার গল্প শোনেন দেবকুমারবাবু ৷ সেই কাহিনি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ছুটে যান গুজরাত ৷ তিনি বলেন- ‘‘বেশ কিছুদিন অসহায়ের মতো সুরাত সহ বিভিন্ন জায়গা ঘুরে বেরিয়েছি ৷ অবশেষে এই এই কাজ জোটে প্যাটেল নগরের একটি এমব্রয়ডারি কারখানায় ৷ এই কাজ শিখতে লেগেছিল ন’ দিন ৷ আর নয় বছর পর আজ আমি নিজের কোম্পানি চালাচ্ছি, ‘জয়রাম গার্মেন্টস।’’

গুজরাত থেকে বাড়ি ফেরার কিছু দিন পরেই তাঁর বাবার মৃত্যু হয় ৷ কঠোর পরিশ্রম থেকে মা-কে ছুটি দিয়ে সংসারের হাল ধরেন তিনি ৷ শুরু হয় তাঁর জয় যাত্রা ৷ গরিব, দুস্থ মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাটা ছোট থেকেই তাঁর মনে বাসা বেঁধেছিল ৷ ২০১৫ সালে তাঁর বাড়ির আশেপাশের কিছু গৃহহীন মানুষের মুখে প্রতিদিন অন্ন তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নেন ৷

কিন্তু একদিনের একটি ঘটনা নাড়া দিয়ে যায় দেবকুমারকে ৷ এক বৃদ্ধ তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর মুখে খাবার তুলে দেওয়ার জন্য দেড়কুমারবাবুর কাছে সাহায্য চান ৷ এই অনুরোধে বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন তিনি ৷ বেশ বড় বাড়ির এক সদস্য কেন এমন আনুরোধ জানাচ্ছে ? পরে জানতে পারেন, সমস্ত সম্পত্তি হাতিয়ে এই বাড়িতে মরার জন্য ফেলে রেখে গেছে তাঁদের একমাত্র ছেলে৷ এই ঘটনার পর দেবকুমার বাবু এমন সব মানুষের খোঁজ শুরু করেন, যাদের সবকিছু থেকেও আজ তারা নিঃস্ব ৷ সোশ্যাল মিডিয়ায় অনুসন্ধান পর্ব শুরু হতেই আবেদনের জোয়ার আসে ৷ আজ প্রায় ৮০ জন বয়স্ক মানুষের কাছে তাঁর হয়ে  প্রতিদিন খাবার পৌঁছে দেন তপন দত্ত নামে এক ব্যক্তি ৷ মানুষের সেবা করার অদম্য ইচ্ছা দেখে আর দেরি করেননি তপন বাবু ৷ আজ নিজের ভাইয়ের মতোই তাঁর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন তপনবাবু ৷

তপনবাবু জানান, দেবকুমারবাবু একটি মন্দির গড়ে তুলেছেন , যেখানে ৮০ জন  প্রবীণকে নিত্যদিন দু’বেলা খাওয়ানো হয় ৷ খাবার যদিও সাদামাটা ৷ ভাত, ডাল এবং একটি সবজি ৷ প্রতিদিন ঘুরিয়ে ফিরেয়ে সবজি দেওয়া হয় ৷ মাঝে মাঝে খাবারের সঙ্গে আসে মিষ্টি ৷ একদিন দেব কুমারবাবুর কর্মীদের খাবার বিতরণ করতে দেখে রাহুল নামের এক কলেজ পড়ুয়া ৷ আগ্রহের বশেই জানতে চান বিষয়টি ৷ দেবকুমারবাবুর এই মহৎ কাজে উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেন তাদের কর্মকাণ্ডে ৷ রাহুল বলেন- “একটি দিনের জন্যও আমি এই কাজের সুযোগ হারাতে চাই না ৷ ঝড়-বৃষ্টি যাই আসুক, প্রতিদিন ৮০ জনের কাছে খাবার পৌঁছে দিই আমরা ৷’’

দেব কুমারবাবু বলেন, ‘অনেকেই আমাকে প্রতারক ভাবে ৷ ভাবে আমি নাম পাওয়ার লোভে এসব দেখাচ্ছি ৷ কিন্তু কারোর থেকে আমার কোনও কিছু লুকানোর নেই ৷ প্রতিদিন, ৪,৮০০ টাকা ব্যয় করি আমি ৷ ভগবানের আশীর্বাদে এই খরচ করার ক্ষমতা হয়েছে আমার ৷’  অনেকে সাহায্য করতে চাইলেও তিনি নিজের ক্ষমতাতেই সবটা সামলান ৷

বাবার মৃত্যুর পর বাঙালি রীতি মেনে ১৪ দিন সাদা পোশাক পরেছিলেন দেবকুমারবাবু ৷ এক পন্ডিত তাঁকে বলেছিলেন, শোকের রূপক হিসেবেই এই সাদা বস্ত্র ৷ কিন্তু তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে তবে কি শোক ১৪ দিনের? সেই দিনই সিন্ধান্ত নেন সারা জীবন সাদা বস্ত্র পরবেন ৷ আজ শুধুমাত্রই সাদা জামা- প্যান্ট পরেন তিনি ৷ দরিদ্র মানুষের শেষকৃত্যও তিনি সম্পন্ন করেন ১ টাকার বিনিময়ে ৷ স্ত্রী ও কন্যা নিয়ে দেবকুমারবাবুর পরিবার ৷ কিন্তু বরাহনগর, আগরপাড়া, পানিহাটি, সোদপুরের বহু মানুষের সর্বজনীন ‘ছেলে’ তিনি ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × two =