বিশ্বদীপ নন্দী, বালুরঘাট: বাংলার আকাশ জুড়ে পুজোর গন্ধ৷ শরতের নীলাকাশ, কাশের দোলা আর শিউলির ঘ্রান জানান দিয়েছে মা আসছেন৷ মানুষের মনে আজ উৎসবের আমেজ৷ কিন্তু সব আনন্দের মাঝে কাঁটা হয়ে বিঁধে রয়েছে মারণ করোনা ভাইরাস৷ পদে পদে জড়িয়ে রয়েছে বিপদ৷ মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তাই শতাব্দী প্রাচীন প্রথা ভেঙে প্রতিমার বদলে এবছর ঘট পুজোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার পতিরামের জমিদার বাড়ি৷
আরও পড়ুন- বিধানসভায় ৯০ হাজার ভোটে জিতব! বিজেপিকে খোলা চ্যালেঞ্জ অনুব্রতর
জমিদার ঘোষ বাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকার সত্তরোর্ধ ঘোষ দম্পতি সাগর ঘোষ ও কল্পনা ঘোষ চান না উৎসবের জোয়ারে ভেসে বিপদ ডেকে আনুক এলাকার মানুষ৷ তাই একরাশ বিষন্নতা নিয়েই এই সিদ্ধান্ত তাঁদের৷ প্রতি বছর আগমনীর সুরে মেতে ওঠা পতিরামের জমিদার বাড়ির পুজোয় এবার করোনার কালো ছায়া৷ নেই সেই প্রাণোচ্ছ্বলতা৷ ঘোষ দম্পতির কথায়, মূর্তি পুজো হলে মানুষও ভিড় জমাবে৷ তাঁদের বাঁধা দেওয়াও সম্ভব হবে না৷ মানুষের জীবনের স্বার্থেই এই কঠিন সিদ্ধান্ত৷ তবে মূর্তি না থাকলেও, ষোড়ষী আচারের নিয়ম মেনেই পুজো হবে। মাতৃ আরাধনায় কোনও খামতি রাখতে চান না তাঁরা।
অন্যান্য বছর এই সময় থেকেই জমিদার বাড়িতে শুরু হয়ে যায় আত্মীয় সমাগম৷ অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দিতে ঘোষ বাড়ির দালানেই ভিড় জমান এই তল্লাটের আট থেকে আশি৷ সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী- পুজোর তিনদিনই ভোগ খাওয়ার জন্য মণ্ডপের সামনে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়৷ দশমীর সন্ধ্যায় মায়ের বিদায় বেলায় সিঁদুর খেলা ঘোষ বাড়ির অন্যতন ঐতিহ্য৷ কিন্তু এবার আর সিঁদুরে রাঙা হবে না ঘোষ বাড়ির দালান৷
আরও পড়ুন- লোক কই? প্রধান কোথায়? বাড়ি থেকে তুলে আনার নির্দেশ অনুব্রতর
ছয় পুরুষ ধরে চলে আসছে জমিদার ঘোষ বাড়ির এই দুর্গাপুজো৷ বর্তমান গৃহকর্তা সাগর ঘোষ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত৷ আনুমানিক ২৫০ বছর আগে শুরু হওয়া এই দুর্গাপূজার দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে৷ প্রথম দিকে পতিরামের এই জমিদার বাড়িতে মা দুর্গা পূজিত হতেন টিনের চালা ঘরে। সেই সময় ঘোষ বাড়ির পূর্ব পুরুষদের ছিল ধান, চালের ব্যবসা। আত্রাই নদীপথে সেই ধান, চাল রপ্তানি হত তত্কাযলীন পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে। সেই সময় দুর্গাপুজার সপ্তমী থেকে নবমী পর্যন্ত মঙ্গলচন্ডীর গানের আসর যাত্রা বসত জমিদার বাড়ির মন্দির প্রাঙ্গনে। আগে বলি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত থাকলেও দিন বদলের সঙ্গে সেই প্রথাও এখন অতীত৷ জমিদার বাড়ির পুজোর অন্যতম বৈশিষ্ট হল, এখানে মাকে অন্ন ভোগ দেওয়া হয় না৷ বদলে পুজো হয় ফল, মিষ্টি, লুচি, পায়েস দিয়ে৷ হয় নিত্য পুজো৷ পঞ্চমীর দিন নারায়ণ পূজার পর ষষ্ঠীর দিন বেলগাছতলায় হয় দেবীর বোধন৷ দশমীর দিন নৌকা পুজো দেওয়ার একটা রীতিও চলে আসছে জমিদার ঘোষেদের পুজোতে। সময়ের স্রোতে জমিদারির প্রাচুর্য কমলেও শতাব্দী প্রাচীন এই বাড়ির পরতে পরতে রয়েছে আভিজাত্যের ছোঁয়া৷ এক সময় স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই বাড়ির পূর্ব পুরুষরা৷ এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহচার্যেও৷
ঘোষ দম্পতির কথায়, করোনার আবহে আনন্দ-উৎসব করতেও সংকোচ হয়। তাই ভেবেছি এবারটা না হয় ঘট পুজোই হল। মন তো ভীষণই খারাপ। কিন্তু করোনাকালে এটাই মনে হয় সঠিক সিদ্ধান্ত। পুজোর জন্য সামনে তো সব বছরগুলো পড়েই রইল। তখন আবার মেতে উঠব উৎসবের আমেজে৷
আরও পড়ুন- ২১-এর আগে নন্দীগ্রামে অগ্নিপরীক্ষা তৃণমূলের, সুর চড়াচ্ছেন বহিষ্কৃত শাবহুদ্দিন
করোনা শুধু পুজোর আনন্দেই বাধ সাধেনি৷ করোনা পরিস্থিতিতে কাজ হারিয়েছেন বহু শিল্পী৷ ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছে তাঁরা৷ ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমেই দর্শকদের কাছে পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁদের প্রতিভা৷ কারুশিল্পী ও অঙ্কনশিল্পীরাও তাঁদের শিল্পসত্ত্বার বিকাশ ঘটিয়েছেন। বালুরঘাটের অঙ্কন শিল্পী ভাস্কর বসাক জানান, লকডাউনের মাঝে কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মনমরা হয়ে পরেছিলেন তিনি। কিন্তু হার মানেননি৷ দুর্গাপুজোকে সামনে রেখে তৈরি করে ফেলেন দুর্গা প্রতিমা। সঙ্গে আছেন লক্ষ্মী, গণেশ, কর্তিক আর সরস্বতীও৷ প্রায় দু’ হাত উচ্চতার এই প্রতিমা তৈরি করতে ভাস্কর বাবুর খরচ হয়েছে আড়াই হাজার টাকা৷ শুধু প্রতিমা তৈরিই নয়, পরিবারের ইচ্ছাকে সম্মতি জানিয়ে নিয়ম মেনে এই বছর বাড়িতে সেই মূর্তি পুজোও করবেন তিনি৷ ভাস্করবাবু ও তাঁর পরিবারে আশা, মায়ের কৃপা তাঁর পরিবার ও সারা বিশ্বের ওপর বর্ষিত হবে৷ অতিদ্রুত এই সংকট থেকে মুক্তি পাবে বিশ্ববাসী৷