মুখচোরা লাজুক, অথচ অ্যাডভেঞ্চার ছিল ভীষণ প্রিয়, এমনই ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ

মুখচোরা লাজুক, অথচ অ্যাডভেঞ্চার ছিল ভীষণ প্রিয়, এমনই ছিলেন নারায়ণ দেবনাথ

5f8941c3694c8b1cfdd8d23ea711ca67

কলকাতা:  প্রয়াত  বাংলা চিত্রকাহিনি বা কমিকসের প্রাণপুরুষ নারায়ণ দেবনাথ৷  মঙ্গলবার সকাল ১০টা ১৫ মিনিট নাগাদ মিন্টো পার্কের একটি নার্সিংহোমে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন হাঁদা, ভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে, ফন্টে, কেল্টুদের স্রষ্ঠা৷ 

আরও পড়ুন-মমতা সাক্ষাতে অখিলেশের ‘দূত’, নজরে যোগীরাজ্যের ভোট

নারায়ণ দেবনাথের বাবা-জ্যাঠারা ওপার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন এপাড় বাংলায়। হাওড়া শিবপুরে এসে বাড়ি করেন তাঁরা। সেখানেই জন্ম হয় ওঁর। সালটা ১৯২৫৷ নারায়ণ দেবনাথের বাবা-কাকার গয়নার ব্যবসা ছিল। নিজেরাই গয়নার ডিজাইন তৈরি করতেন। সেই সব দেখেই বেড়ে ওঠা এবং আঁকার প্রতি ঝোঁক তৈরি হওয়া। বড় হয়ে আর্ট কলেজেও ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ণ দেবনাথ৷ কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে সেই পাঠ সম্পূর্ণ হয়নি৷ 

হেমচন্দ্র দেবনাথ এবং রমণসোনা দেবীর তিন সন্তানের মধ্যে জেষ্ঠ্য সন্তান ছিলেন নারায়ণ৷ ডাকনাম ছিল নারাণ। বোনেদের খুবই ভালবাসতেন তিনি। ছোটবেলায়  ছিলেন কিছুটা মুখচোরা লাজুক স্বভাবের৷ লাজুক হলেও অ্যাডভেঞ্চার ভীষণ পছন্দ ছিল তাঁর। দোতলা সমান উঁচু জেটি থেকে সোজা গঙ্গায় ঝাপ দিতে একবারও ভাবতেন না৷ সাঁতার কেটে গঙ্গা পাড় হতেন। সুযোগ পেলেই বন্ধুদের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়তেন সাইকেল নিয়ে৷ সন্ধ্যায় পড়তে বসলেও মন থাকত আঁকার দিকে৷ খাতার পাতা ভরে যেত টারজানের দুঃসাহসিক অভিযানে৷ এক সময় বডিবিল্ডার হওয়ার স্বপ্নও দেখতেন তিনি৷ নিয়মিত ক্লাবে গিয়ে শরীরচর্চাও করতেন৷ 

নারায়ণ দেবনাথ পড়াশোনা করেছিলেন পেন্টিং নিয়ে৷ কিন্তু সেই সময় পেন্টিংয় করে স্থায়ী রোজগারের কোনও সুযোগ ছিল না। তাই তিনি চলে যান কমার্শিয়াল আর্টের দিকে৷ বইয়ের প্রচ্ছদ, ইলাস্ট্রেশন আঁকার প্রতি তাঁর বেশ ঝোঁক ছিল। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতেই তিনি যোগাযোগ করেন দেব সাহিত্য কুটিরের সঙ্গে৷ তাঁর সমসাময়িক অনেক শিল্পীই তখন ছিলেন৷ প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইবন্ধু রায়, শৈল চক্রবর্তী, সমর দে, রেবতীভূষণ ঘোষ প্রমুখ৷ কিন্তু তাঁদের সকলের চেয়ে পৃথক একটা ধারা তৈরি করেছিলেন নারায়ণ দেবনাথ৷ 

শুকতারা পত্রিকার সম্পাদক প্রথম তাঁকে কমিকস শুরু করতে বলেছিলেন। সেই মতো, ১৯৬২ সালে হাঁদা আর ভোঁদা এই দুটি চরিত্র নিয়ে ‘শুকতারা’তে কমিকস শুরু করেন নারায়ণ দেবনাথ। সেসময় বাংলা কমিকস বলতে ছিল একমাত্র প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ি বা কাফি খাঁ’র আঁকা শেয়াল পণ্ডিত৷ যা তখন যুগান্তরে প্রকাশিত হত। হাঁদা-ভোঁদা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পাঠকদের সমাদর পায় এবং শুকতারা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। শুরুতে তিনি নিজেই হাঁদা ভোঁদায় অঙ্কন ও কালি বসানোর কাজ করতেন। পরবর্তীতে তা গ্রেস্কেলে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করা হয়।

শিবপুরে খুব ঘিঞ্জি এলাকায় নারায়ণ দেবনাথের বাড়ি। চারপাশে দোকানপাট ভর্তি৷ তাতে সর্বক্ষণ বোকজনের আনাগোনা৷ ছোট থেকেই তিনি দেখতেন, দোকানে ভিড় করা  সেই সব চরিত্ররা নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ ঠাট্টা তামাশা করছেন। যা থেকে তিনি হাঁদা-ভোঁদা গল্পের প্লট পেতে লাগলেন৷ হাঁদা-ভোঁদা চরিত্রদুটিকে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিল মানুষ৷ 

এর পর ১৯৬৫ সালে এল ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ চরিত্রটি৷ ব্যায়ামবীর বাঁটুলের কীর্তিকলাপ পাঠকদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলল৷ নারায়ণ একবার জানিয়েছিলেন, কলেজস্ট্রিট থেকে ফেরার পথে তিনি বাঁটুলের কল্পনা করেছিলেন এবং এর পরেই তার প্রতিকৃতি এঁকে ফেলেন। ২০১২ সালে প্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় বাটুল৷ 

সেই সময় ‘কিশোর ভারতী’ও তাদের জন্য নারায়ণ দেবনাথের কাছ থেকে কমিকস চায়। তখন তিনি হাঁদা-ভোঁদার আদলে নিয়ে এলেন নন্টে-ফন্টে৷ তবে গল্পগুলি ছিল আলাদা। পরে  ‘বাহাদুর বেড়াল ‘ডানপিটে খাঁদু ও তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘গোয়েন্দা কৌশিক’-এর মতো অনেক কমিকস করেছেন। 

শুধু কার্টুনিস্ট বা কমিক শিল্পী নয়, নিজেকে অলঙ্করণ শিল্পী ও শিশু সাহিত্যিক বলতেই পছন্দ করতেন নারায়ণ দেবনাথ। ২০১৩ সালে বঙ্গবিভূষণ ও সাহিত্য আকাদেমি, এবং ২০২১ সালে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত হন নারায়ণ দেবনাথ৷ তবে মানুষের ভালোবাসা তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় পুরস্কার বলেই মনে করতেন নারায়ণ দেবনাথ৷ 


 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *