শ্যামলেশ ঘোষ: মুসলিমদের হাতে গড়া পাখায় বাতাস পান হিন্দুদের উপাস্যরা ! আজ্ঞে হ্যাঁ। তাতে অবশ্য জাত যায় না দেবদেবীদের। কারণ, ধর্মাধর্মের ঊর্ধ্বে সবার উপরে মানুষই যে সত্য।
মানুষটির নাম সেখ আবু কালাম। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিড়লাপুর বাসিন্দা কালামের পরিজনেরা এ কাজে তাঁর সহযােগী। বৃহদাকার এই হাতপাখার দেখা মেলে প্রায় প্রতিটি মন্দিরে, পুজোমণ্ডপে বা আশ্রমে। দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোর আরতিতে পাখা দিয়ে বাতাসের এমন দৃশ্য সচরাচর চোখে পড়ে। সেই হাতপাখার কারিগর সেখ আবু কালাম। এ তাঁর পেশা হলেও, ভিনধর্মের দেবদেবী ও তাদের বিশ্বাসের প্রতি পূর্ণ সম্মান রাখেন তিনি।
বহুকাল ধরেই বাংলায় সম্প্রীতির সুমহান ঐতিহ্য ধরে রেখেছে বাঙালি। হিন্দু-মুসলিম এখানে বহুকাল মিলেমিশে বসবাস করছে দীর্ঘকাল। দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় স্বার্থান্বেষীদের হীন চক্রান্তে সেই ধারা মাঝেমধ্যে যে ব্যাহত হয়নি, তা নয়। কখনও কখনও দূরত্ব বেড়েছে। তবে প্রাণপণে আবার পরস্পরকে বেঁধে ফেলেছে বাঙালি। কিন্তু দিনকাল ভাল নয়। দেশে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে আবার শুরু হয়েছে বিভাজনের অপচেষ্টা। বাংলাও বাদ পড়েনি। তারকেশ্বর মন্দিরের উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান করা হয়েছিল ফিরহাদ হাকিমকে। তাতে কম বিতর্ক হয়নি রাজ্যে। কেন একজন মুসলিমকে মন্দিরের চালকের দায়িত্বে রাখা হল, তা নিয়ে বিস্তর চেঁচামেচি করেছেন হিন্দুত্ববাদীরা। তারা মূলত বিজেপি এবং আরএসএস-এর লোকজন। নিন্দুকেরা বলেন, এহেন কাজ তাদেরই সাজে। কিন্তু তাতে সার্বভৌম ভারতের বহুত্বের ধারণাটি ক্ষুন্ন হয়। ধর্মে ধর্মে বিভেদ বাধিয়ে যারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায় বা আগামীতে ক্ষমতায় আসতে চায়, এই বিদ্বেষীদের গালে যুতসই থাপ্পড় হতে পারেন সেখ আবু কালাম। তাঁরই সুনিপুণ হাতে গড়া পাখায় বাতাস পান পরধর্মের উপাস্যরা।
সেখ আবু কালাম এই হাতপাখাগুলো নিজেই বানান, নিজেই বিক্রি করেন। কালীঘাটে কালীমন্দিরের কাছে সেগুলো বিক্রি হয় দেড়শ টাকা দরে। তাতে একেকটি পাখায় প্রায় ৩০-৪০ টাকা করে লাভ থাকে। সেখ আবু কালাম জানান, ওড়িশা থেকে ডাঁটাসুদ্ধ তালপাতা কিনে আনেন। তার পর সেগুলোকে শুকিয়ে, কাটিং করে, পালিশ করে, বাঁধাই করে, রং করে এবং কাপড়ের কুচি লাগিয়ে তৈরি করেন সুদর্শন হাতপাখাগুলি। এই সব কাজে নিজের পরিজনদের মজুরি হিসেবে কিছু রােজগারও হয়ে যায়। তিনি আরও জানান, বাড়িতে বাড়িতে, মন্দিরে, আশ্রমে পূজার্চনায় এই পাখা বহুল প্রচলিত। তিনি দুর্গাপুজোর মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে গিয়ে এই ধরনের পাখা দেখতে পান এবং তারপরই সেগুলি তৈরির চিন্তা মাথায় আসে। আস্তে আস্তে এই বৃহৎ পাখা তৈরিতে হাত পাকান। সেই থেকে দীর্ঘ বছর ধরে এই হাতপাখা বানিয়ে আসছেন তিনি। ধর্মাধর্ম বোঝেন না, তার হাতে গড়া পাখা উপাসনার কাজে লাগে, এই ভেবেই তৃপ্ত সেখ আবু কালাম।
দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি, সংখ্যালঘু সংগঠন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের তরফে বারবার অভিযোগ তোলা হচ্ছে, বর্তমানে দেশের ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং তাদের অভিভাবক আরএসএস ভারতের বহুত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করতে চাইছে। দেশের সহিষ্ণুতার বাতাবরণের বিরুদ্ধেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তারা। সকলের ‘বিকাশের’ বাণী নিয়ে ক্ষমতায় এসে নিজেদের কাজে ডাহা ফেল তারা। বিকাশের যা কিছু, সব আদতে পুঁজিপতিদের জন্য। সাধারণ মানুষের কাছে উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও এসে পৌঁছয়নি। উল্টে দেশের সম্পদ লুটেরাদের হাত ধরে চলে গিয়েছে বিদেশে। তাই ঘৃণা ও বিভাজনের রাজনীতিই তাদের হাতিয়ার। নতুন নতুন ইস্যু তুলে ধরে হাঙ্গামা বাধানোর চেষ্টা চলছে, ধর্মে ধর্মে বিভেদ লাগিয়ে কার্যসিদ্ধি করতে চাইছে তারা। উন্নয়ন বা সুশাসন দিতে না পেরে ২০১৯-এর ভােট-বৈতরণি পার হওয়ার জন্য হিন্দুত্বকেই ষাঁড়ের লেজ হিসেবে ধরতে চেষ্টা করছে।বাংলায় সে চেষ্টা যে মাঠে মারা যাবে, তা বুঝতে পেরেই ভেদাভেদের খেলায় মেতেছে দুর্জনেরা। কিন্তু বাঙালি যে বিভাজনের খেলার খেলোয়াড় না, সেখ আবু কালামরা যুগ যুগ ধরে তার প্রমাণ দিয়ে আসছেন যে।।