হাই-ফাই, নাকি সাধারণ নববর্ষ? কোন দিকে বাঙালির সেলিব্রেশন

বং কানেকশনে এই একটিই তো দিন! বাকি দিন এলেবেলে। বাকি দিনগুলোয় কানেকশনই নেই। বাঙালির বাঙালিপন লকলকিয়ে ওঠে এই একটাই দিনে। ‘উদ্যাপন’ তকমায় শুরু হয় বটে, কিন্তু শেষপাতে তা গড়ায় হুলা-লা-লা সেলিব্রেশনে। এটাই দস্তুর। এটাই হয়ে এসেছে জন্ম জন্মান্তরে। হুতোমের নকশায় যদি চোখ রাখেন, দেখতে পাবেন, গাজনের সিকোয়েল হিসেবে নববর্ষ একটু স্তিমিত হলেও তারও বুকের ভিতর

হাই-ফাই, নাকি সাধারণ নববর্ষ? কোন দিকে বাঙালির সেলিব্রেশন

বং কানেকশনে এই একটিই তো দিন! বাকি দিন এলেবেলে। বাকি দিনগুলোয় কানেকশনই নেই। বাঙালির বাঙালিপন লকলকিয়ে ওঠে এই একটাই দিনে। ‘উদ্‌যাপন’ তকমায় শুরু হয় বটে, কিন্তু শেষপাতে তা গড়ায় হুলা-লা-লা সেলিব্রেশনে। এটাই দস্তুর। এটাই হয়ে এসেছে জন্ম জন্মান্তরে।

হুতোমের নকশায় যদি চোখ রাখেন, দেখতে পাবেন, গাজনের সিকোয়েল হিসেবে নববর্ষ একটু স্তিমিত হলেও তারও বুকের ভিতর আগুন ছিল। সম্বচ্ছরের ফুর্তির মেনুটা পাখসাট মেরে এই দিনই নামিয়ে দিত বাঙালিয় খাতায়-কলমে না হোক, মনে মনে। ইংরেজি নববর্ষে যেমন রেজলিউশন, বাংলায় তেমনটা নেই। বচ্ছরকারে এই দিনটিতে গত দেড় দশকে বাঙালি একটাই হিসেব কষেছে, কেমন হবে এই বছরের সেলিব্রেশন? বাঙালির নতুন প্রজন্মে এই মুহূর্তে দু’টিই মাত্র শব্দ— ‘সেলিব্রিটি’ আর ‘সেলিব্রেশন’। সাড়ে নিরানব্বই শতাংশ বাঙালির অ্যাম্বিশন ‘সেলিব্রিটি’ হওন। তা সে যে কোনও উপায়েই হোক না কেন। আর যাঁরা একটু থকে আছেন, সেলেব হতে গিয়ে বুঝেছেন, ব্যাপারটা অত সোজা নয়। কেবল কারুবিদ্যে আওড়ালেই খ্যাতজন হওয়া যায় না। সোনার বাংলায় সোনাপারা মুখ করে কত কী যে সয়ে যেতে হয়! তার চেয়ে বরং ‘সেলিব্রেশন’ ভাল। খুল্লমখুল্লা খোলা রয়েছে মদের দোকান। বছরে ৩৬৩ দিন। বাইকবাজি আর বিয়ারবাজির কম্বিনেশনে সেলিব্রেশন সারা বছর।

তা হলে আলাদা করে আর কী রইল? কী তোলা রইল এই পয়লা নম্বরের জন্য? আজ থেকে তিরিশ বছর আগে কাঠের ঢাকনা ‌খুলে টেলিভিশনে সপরিবারে বাঙালি ডিডি-র যে অনুষ্ঠান দেখত, সেই কিসিমের বিনোদন যদি এই তিন দশক পরের বাঙালিকে দেখানো যায়, তবে গায়ে পচা থুড়ি প্লাস্টিকের ডিম এসে পড়তে পারে। আজকের প্রজন্ম ভাবতেও পারবেন না, সেই বেজায় গরমে উনিশ শতকের বাবু-র কস্টিউমে ক্ল্যাড হতে গিয়ে বাঙালি কী কষ্টটাই না করেছে! আচ্ছা, কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল পয়লা বৈশাখ মানাতে গেলে ১৯ শতকের রেট্রোকেই তুলে ধরতে হবে? এখনও পর্যন্ত এই এক আর্কিটাইপ বাঙালির ঘাড়ে সিন্দবাদের নাছোরবান্দা বুড়োর মতো লটকে রয়েছে। ঠান্ডা পানীয়ের অ্যাডে আমির খান থেকে শুরু করে উপরে উদ্ধৃত ‘লাগে রহো মুন্নাভাই’ ছবির সেই দৃশ্য পর্যন্ত, এমনকী সাম্প্রতিক কালে আইপিএল-এর উদ্বোধনে শ্রদ্ধা কপূরের ‘হাম্মা হাম্মা’-র পিছনে যে বং বেইবি-রা নেত্য করেছেন, তেনাদের কস্টিউমে পর্যন্ত এই আর্কিটাইপেরই জয়জয়কার।

কে সেট করেছিল বাঙালির সেলিব্রেশনের বাঙালিপনার গ্রামার? খোঁজ নিন, দেখতে পাবেন। এই ক্যালানে-মার্কা ছৈরতের পিছনে মেন অবদানটা অবাঙালিদের। অমিতাভ বচ্চনের ‘দেশপ্রেমী’ ছবিতে উত্তম কুমারের পোশাকটাও ভাবুন। সেই থেকে বাঙালি মানেই লতপতে একটা জীব— এই ধারণা প্রথমে ন্যশনাল আর তার পরে গ্লোবাল পরিসরে এমন জেঁকে বসে রয়েছে, তাকে হঠানোর কোনও ক্ষমতাই এই বঙ্গের বাঙালির নেই। তার উপরে এই কস্টিউম আজ সেলিব্রেশনের অঙ্গ। ক্রিকেটীয় ধামাকা থেকে শুরু করে ‘বাঙালি খানা’-র ওয়েটার পর্যন্ত একই জেল্লায়। এটাই তা হলে স্বাভাবিক? নেক্সট জেন বং আর এনআরআই বাঙালি আজ বিশ্বাস করেন এই কিসিমের সেলিব্রেশনেই। গ্লোবাল পরিসরে সকলি গরল ভেল। বাঙালির আইডেন্টিটি একেবারেই লেপটে গিয়েছে ওই পোশাকের সঙ্গে।

এর পরে বাকি যা থাকে, তা খানা-পিনা। পিনা-র ব্যাপারে বাঙালি পোস্ট কলোনিয়াল। দিশি, ধেনোকে সে আজও ‘ভদ্রলোকের পানীয়’ বলে মনে করে না। ফ্রান্স বা স্কটল্যান্ডের মতো বাংলা কান্ট্রি স্পিরিটকে জাতে তুলতে পারেনি। তুলতে চাওয়া হয়নি অবশ্য। তবে খানা-র ব্যাপারে সে কামাল করেছে গত বিশ বছরে। মাল্টি কুইজিন কলকেতায় সে ‘বাঙালি খানা’ বলে যে পদার্থের জন্ম দিয়েছে, যার স‌ঙ্গে বাঙালির সেলিব্রেশনও ক্রমে ওতপ্রোত, সেই খানার কতটা ‘বাঙালি’, তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন না। মোচার ঘন্ট, ইলিশ ভাপা বাঙালির ডিশ হতে পারে, কিন্তু ডাব চিংড়ি? পনিরের আইটেম? আজকের সেলিব্রেশনে কিন্তু এগুলো অপরিহার্য। এই পোশাক, এই খানা না হলে বাঙালি মানতেই চাইবে না এটা সুইট-কিউট পয়লা বৈশাখ। কোমরে ইলাস্টিক দেয়া ধুতি আর শেরওয়ানির ক্লোন পাঞ্জাবি পরে দুপুরে এথনিক জয়েন্টে কচি পাঁটা দিয়ে তুলাইপাঞ্জির ভাত খেয়ে বংশ নামবে সন্ধের ডিস্কো-য়। ইনকগনিটো বাঙালির উৎসব সাঁঝ। কোমরের নীচে বিপদসীমা অতিক্রম করে শাড়ি, ফ্রি ফলিং ধুতি। দপদপে আলোয় কাঁপছে নাচ-বাসর। স্কচের কড়া গন্ধে, কৃত্রিম ধোঁয়ায়, সাড়ে বত্রিশ ভাজা মিশে যায়। সেলিব্রেশন প্রতিদিনের। চিয়ার্স!!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *