কলকাতা: এক কথায় বলা যায় বেনজির আক্রমণ! রাজ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব সিংহকে যে নজিরবিহীন ভাষায় তোপ দেগেছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস, তা অতীতে কোনও রাজ্যপালের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। দীর্ঘ সাংবাদিক বৈঠকে একের পর এক বাউন্সারে বিদ্ধ করেছেন নির্বাচন কমিশনারকে। রাজীবের উদ্দেশে রাজ্যপাল বলেছেন, ”কেন এত হিংসা? মিস্টার রাজ্য নির্বাচন কমিশনার, আপনার কর্তব্য কি আপনি পালন করছেন? মানুষ বলছে নকল ব্যালট পেপার ছাপা হচ্ছে। আধিকারিকরা মৃত্যু দেখেও নিষ্ক্রিয়। আপনি কার পক্ষে দাঁড়াবেন, সত্যের পক্ষে নাকি হিংসার পক্ষে? মানুষের রক্ত নিয়ে রাজনীতির হোলি খেলা বন্ধ করতে মাঠে নামুন। মানুষের কণ্ঠস্বর শুনুন, মানুষের কথাই ঈশ্বরের কথা। রাস্তায় যে শবদেহ পড়ে রয়েছে তার জন্য আপনিই দায়ী।”
সেই সঙ্গে বলেছেন, “আপনাকে আমি নিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু আপনি রাজ্যবাসীকে হতাশ করেছেন। দায়িত্ব পালনে আপনি ব্যর্থ।” এর পাশাপাশি আরও অনেক চোখা চোখা বিশেষণ ব্যবহার করে রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে নিশানা করেছেন রাজ্যপাল। ঘটনা হল রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান রাজ্যপাল, অন্যদিকে সাংবিধানিক সংস্থা রাজ্য নির্বাচন কমিশন। তাই প্রশ্ন, কমিশনের প্রধানকে এভাবে কী রাজ্যপাল নিশানা করতে পারেন? সবচেয়ে বড় কথা রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছেন খোদ রাজ্যপালই। সেখানে রাজ্যপাল এমন কড়া মন্তব্য করায় ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলছে। যদিও বিরোধীদের দাবি রাজ্যপাল ঠিক কথাই বলছেন।
পঞ্চায়েত নির্বাচনকে শাসক দল ধারাবাহিক সন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রহসনে পরিণত করেছে এবং তাতে ইন্ধন জুগিয়ে গিয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন, এমনটাই অভিযোগ বিরোধীদের। এ প্রসঙ্গে সিপিএমের আইনজীবী নেতা বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, ”রাজ্যপাল যদি মনে করেন নির্বাচন কমিশনার ঠিকমতো কাজ করেননি সেই মত প্রকাশ করার অধিকার তাঁর আছে। সাংবিধানিক প্রধান হিসেবে তিনি কিছু বলতেই পারেন, পরামর্শ দিতেই পারেন। তাতে তৃণমূলের আপত্তির কারণ কি থাকতে পারে? তবে কি তৃণমূল চাইছে রাজ্য জুড়ে অরাজকতার অবস্থা থাকুক? তৃণমূলের রাজনৈতিক মুখোশ খুলে গেল এই ঘটনার মধ্য দিয়ে।”
অন্যদিকে তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষের দাবি, রাজ্যপাল বিজেপির দালাল হিসেবে কাজ করছেন। সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্যপাল ‘এপিসোড’ রাজ্য রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান চর্চিত বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে।
জগদীপ ধনকড় যখন বাংলার রাজ্যপাল ছিলেন তিনিও আইনশৃঙ্খলা ইস্যুতে বহুবার সরব হয়েছিলেন রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাঁকেও কোনও দিন এই তীব্র ভাষায় আক্রমণ শানাতে দেখা যায়নি। তবে তৃণমূল এখন রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও অতীতের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাদের এই অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বাম জমানায় নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পর তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী সেখানে ছুটে গিয়ে আহতদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। হাড়হিম করা সন্ত্রাস বলেছিলেন। রাজ্যপাল বলেছিলেন, “নন্দীগ্রামে পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষের মৃত্যুর খবর আমার মনে আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। এত মানুষের মৃত্যুর রক্তপাত কি এড়ানো যেত না?”
সেই সময় রাজ্যপালের নন্দীগ্রাম সফরের বিরোধিতা করেছিল বাম সরকার। আর এখন রাজ্যপালের সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় সফরের বিরোধিতা করছে তৃণমূল সরকার। কয়েক বছর আগে একটি কর্মসূচিতে উপস্থিত হয়ে নন্দীগ্রামের ঘটনার কথা তুলে ধরে গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে বলতে শোনা গিয়েছিল, “নন্দীগ্রামে যে ঘটনা ঘটেছিল, রাজ্যপাল হিসেবে আমি তার সমালোচনা করে যে কাজ করেছিলাম, যা বলেছিলাম, তা আমার কর্তব্য ছিল বলেই মনে করি। কোনও রাজ্যের প্রশাসনিক অবক্ষয় দেখে রাজ্যপাল চুপ করে থাকতে পারেন না। আমিও সেটা পারিনি। সেই সময় রাজ্যে কোন দল ক্ষমতায় ছিল সেটা বড় কথা নয়, যে দলই থাকুক না কেন, আমি এমন হলে একই কাজ করতাম।”
তাই প্রশ্ন উঠছে, নন্দীগ্রাম ঘটনার পর গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর পাশে তৃণমূল দাঁড়ালেও এখন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস যেভাবে সন্ত্রাসের নিন্দা করছেন, তার বিরোধিতা কেন করছে তৃণমূল? এটা কি তৃণমূলের দ্বিচারিতা নয়? এই প্রশ্ন তুলছে বিরোধীরা। সব মিলিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে রাজ্যপালের নজিরবিহীন মন্তব্য নিয়ে রাজ্য জুড়ে চর্চা এখন তুঙ্গে।