establishments
নিজস্ব প্রতিনিধি: বছরের পর বছর ধরে বাঙালির জীবনে জড়িয়ে থাকা একটি জুতোর দোকানের বিজ্ঞাপনের ট্যাগ লাইন হচ্ছে, “পুজোয় চাই নতুন জুতো”। আট থেকে আশি, দিনের পর দিন ভিড় জমিয়েছেন সেখানে। সত্তর বা আশির দশকে সেই জুতো কোম্পানির প্রত্যেকটি শাখায় এতটাই ভিড় উপচে পড়ত যে, ভিতরে প্রবেশ করাটাই কঠিন হতো। পুজোর সময় ভিড় সামলাতে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কর্মী নিয়োগ পর্যন্ত করতে হতো তাদের বিভিন্ন শাখায়।
পুজোর সময় বাচ্চাদের জুতো কিনলেই তাদের উপহার স্বরূপ দেওয়া হতো বেলুন। কিন্তু পরবর্তীকালে কলকাতা তথা রাজ্য জুড়ে অপেক্ষাকৃত অনেক কম দামে নানা ধরনের ফ্যান্সি জুতো বা চটি প্রস্তুতকারী সংস্থা একের পর এক আউটলেট খুলতে থাকে। তাতে জোর ধাক্কা খেতে শুরু করে বাঙালির জীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলা সেই কালজয়ী জুতো কোম্পানির ব্যবসা। এখন সেই কোম্পানির অবস্থা খুবই সঙ্গীন। তাদের বিভিন্ন শাখাগুলিতে সেভাবে ভিড় চোখে পড়ে না। পুজোর সময় কিছুটা ব্যবসা হলেও সারা বছর ক’জন ক্রেতা সেখানে যান তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে। এ তো গেল সেই বিশেষ জুতো কোম্পানির কথা। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে কলকাতা তথা জেলা শহরগুলিতেও গজিয়ে উঠেছে একের পর এক ঝাঁ চকচকে শপিং মল। কি পাওয়া যায় না সেখানে! সেই সঙ্গে নানা বিজ্ঞাপনী চমক। একটা কিনলে একটা ফ্রি, সঙ্গে আবার আগামী দিনের জন্য ডিসকাউন্ট কুপন। এই ধরনের নানা আকর্ষণী অফার থাকে ক্রেতাদের জন্য। তথাকথিত দোকানগুলির তুলনায় দাম বেশি হলেও এমন ভাবে বিষয়গুলিকে ক্রেতাদের সামনে তুলে ধরা হয়, যাতে আকৃষ্ট হয়ে সেখান থেকে অধিকাংশ মানুষ কিছু না কিনে যেন বের হতে পারেন না। চারদিকে চকচকে ঝকঝকে ভাব, আলোর রোশনাই, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ইউনিফর্ম পরা পুরুষ-মহিলা কর্মী, প্রয়োজনে কেউ যেতে পারবেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেটেও। এক কথায় এগুলি অত্যন্ত চেনা ছবি যে কোনও শপিংমলের। এর পাশাপাশি বহু শপিংমল কমপ্লেক্সে থাকে ফুড কোর্ট। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষের একটা বড় অংশ নির্দ্বিধায় সেখানে গিয়ে কেনাকাটা করতে দু’বার ভাবেন না। এবারের পুজোতেও এর ব্যতিক্রম কিছু হয়নি।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে তবে কী দীর্ঘদিনের চেনা দোকানগুলির ব্যবসা পুরোপুরি মার খেয়েছে শপিংমলগুলির জন্য? সেটা কিন্তু বলা যাবে না। আসলে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের প্রতিটি রাজ্যেই জনসংখ্যা বেশি থাকার কারণে মোটের উপর সকলেই ব্যবসা যতটা পারছেন নিজের মতো করে সামলে নিচ্ছেন। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে এই সময় কালে শপিংমল মারাত্মকভাবে থাবা বসিয়েছে গতানুগতিক ভাবে চলতে থাকা দোকানগুলির ব্যবসার উপর। বিষয়টি নিয়ে মার্কেট এক্সপার্টরা বলছেন, এই সমস্ত দোকান যারা চালাচ্ছেন তাঁদের চিন্তাধারায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। সবার পক্ষে হয়ত দোকানে এয়ারকন্ডিশন ব্যবস্থা রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু এটা না করেও দোকান পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, ক্রেতাদের সুন্দরভাবে বসবার ব্যবস্থা করে দেওয়া, পানীয় জলের ব্যবস্থা রাখা, ক্রেতাদের সঙ্গে দোকান কর্মীদের ভাল ব্যবহার, এগুলি করলে ব্যবসা বাড়তে বাধ্য। এছাড়া শপিংমল যেভাবে বিভিন্ন ডিসকাউন্ট কুপন বা গিফট দিয়ে ক্রেতা টানে, সাধারণ দোকানগুলিরও উচিত সেই রাস্তায় হাঁটা। সেই সঙ্গে দাম মোটের উপর নাগালের মধ্যে রাখতে হবে। এমনটাই মনে করছেন বাজার বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের কথায়, ক্রেতাকে ‘কমফোর্ট জোন’ দিতে পারলে তিনি শপিংমল ছেড়ে সাধারণ দোকানে আসতে বাধ্য।
ঘটনা হল প্রখ্যাত ওই জুতো কোম্পানির বিভিন্ন প্রোডাক্টের দাম বাজার চলতি অন্যান্য সংস্থার চেয়ে অনেকটাই বেশি হওয়ায় ধীরে ধীরে তাদের ক্রেতার সংখ্যা কমতে শুরু করেছে গত দু’দশক ধরে। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। মধ্য কলকাতায় এমন অনেক প্রসিদ্ধ শাড়ির দোকান আছে যাদের দোকান থেকে শাড়ি না কিনলে একটা সময় মহিলাদের মন খুঁত খুঁত করত। পুরনো দিনের বহু বাংলা ছবিতে সেই সমস্ত দোকানের উজ্জ্বল উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু যুগের হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার কারণে অনেকেরই ব্যবসা আজ ধুঁকছে। তাঁদের অনেকেই দোকানে কর্মীর সংখ্যা কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই শুধু শপিংমলের দোহাই দিলে চলবে না। ব্যবসা সংক্রান্ত চিন্তাধারাকে অন্য পথে নিয়ে যেতে না পারলে আগামী দিনে অনেকেরই অবস্থা আরও করুণ হতে পারে। তেইশের দুর্গাপুজোর কেনাকাটা সেই আশঙ্কা কিন্তু ফের একবার উস্কে দিল।